ছোটগল্প-মিকসেতু মিঠু

উত্তর নেই জানা

মিকসেতু মিঠু


অনেক দিন পর প্রিয় শহরে হাঁটতে বের হলাম। প্রিয় ফুটপাত, প্রিয় রাস্তা, প্রিয় মানুষজন সব মিলিয়ে অদ্ভুদ এক নস্টালজিয়া আমাকে যেন গ্রাস করতে চাচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ফুটপাত দিয়ে হাঁটছিলাম। যখন এই শহরে ছিলাম এই ফুটপাত দিয়েই বেশি হাঁটাহাঁটি করেছি, কখনও একা, কখনও ও ছিলো পাশে। এই ফুটপাতের প্রতিটা ধূলিকণা পর্যন্ত আমার চেনা। কতো সন্ধ্যা, কতো রাত এখানে বসে থেকেছি। কতো বিকাল এর উপর দিয়ে হেঁটেছি পাশাপাশি। যাক সেসব পুরনো কথা মনে করতে চাই না।
সন্ধ্যা নেমে গেছে, রাস্তা অনেক ব্যস্ত। আমি ধিরে ধীরে হাঁটছি। হঠাৎ কে যেনো বললো- “কি ব্যাপার, কেমন আছো?’’
আশেপাশে কোন লোকজন নেই, তাহলে কে কথা বললো? আমি কথার উৎস খোঁজার চেষ্টা করছি, এমন সময় দেখি ফুটপাতের ধারে গজিয়ে ওঠা একটা ছোট সাইজের গাছ কথা বলছে। প্রথমে অবাক হয়েছিলাম, পরে কি ভেবে উত্তর দিলাম-“ এইতো আছি।”
-“ অনেক দিন পর আসলে মনে হয়?”
- হ্যাঁ, তুমি বুঝলে কিভাবে? তুমি আমাকে চেনো নাকি?
- চিনবো না কেন? তুমি আর একটা মেয়ে কি যেন নাম, তোমরা দুজন এই পথে পাশাপাশি হেঁটে যেতে, আর আমরা মুগ্ধ হয়ে দেখতাম। তোমাদের দুজনকে আমরা অনেক পছন্দ করি জানো?
- কার কথা বলছো?
- আরে ঐ মেয়েটা, চশমা পরতো, হ্যাঁ, মনে পরছে- যাকে তুমি ‘মিথিলা’ নামে ডাকতে।
-“ ও আচ্ছা... আবারও মিথিলা। এই নামটা আমি ভুলে যেতে চাই, অথচ সবাই বার বার মনে করিয়ে দিচ্ছে কেন, কে জানে।
-‘কেমন আছে ও?’ গাছটা আবারও কথা বলে উঠলো।
- আছে, ভালোই আছে।
- তুমি একা কেনো? ও কোথায়, ও আসেনি?
- ও কোথায় আমি জানি না।
- জানি না মানে?
- জানি না মানে জানি না। আচ্ছা আমি যাই, পরে এক সময় তোমার সাথে কথা বলবো।
- ঠিক আছে, আসিও। ওকে সহ আসিও। আমরা কতদিন থেকে তোমাদের দুজনকে দেখার জন্য অপেক্ষা করে আছি।
আমি আর কথা বাড়ালাম না। গাছপালার সাথে কথা বলছি, মানুষ শুনলে কি ভাববে? মাথা কি পুরোটাই গেলো নাকি? হাঁটতে হাঁটতে “ঢাকা ফাস্ট ফুড” এর সামনে চলে আসলাম। সাইনবোর্ডের দিকে তাকিয়েই কেমন যেনো ক্ষুধা লেগে গেলো। ভেতরে ঢুকে দেখি প্রায় সবগুলো টেবিল’ই দখল হয়ে আছে। একটা টেবিল ফাঁকা পেলাম। এটা সেই টেবিল যেখানে আমরা একদিন বসেছিলাম। ও আর আমি মুখোমুখি বসে অনেক কথা বলেছিলাম সেদিন। এসব ভাবতে ভাবতে আজও বসলাম। পিজার অর্ডার দিয়ে বসে আছি। এমন সময় আমার সামনের চেয়ারটা কথা বললো-“ এতোদিনে আসার সময় হলো বুঝি? তা কেমন আছো? সব ভালো তো?”
চেয়ার কথা বলছে! এবার অবাক হতে ধরেও হলাম না। গাছ যদি কথা বলতে পারে তাহলে চেয়ার কি দোষ করলো? বললাম- “ ভালো আছি। তুমি?”
-আমরা তো সব সময়ই ভালো থাকি। তবে মাঝে মাঝে কিছু মানুষকে মনে পড়ে। যারা এখানে এসে প্রিয় মানুষদের সাথে অনেক মজা করে। এদের অনেক কেই ভালো লেগে যায়। আশায় থাকি তারা আবার আসবে। কিন্তু অনেকেই আর আসে না। তোমার কথাই ধরো। তোমদের আশায় কতদিন বসে থেকেছি, অথচ সেই যে গেলে, আর খবরই নাই।
- এই তো আজ আবার আসলাম।
- এসেছো ঠিক আছে। তা একা কেনো তুমি?
আমি কোনো উত্তর দিতে পারলাম না। আমি নিজেই কি ছাই জানি- কেনো আমি একা?
-চুপ করে আছো যে?
-বলার কিছু নেই তাই
 ততক্ষনে পিজা দিয়ে গেছে। আমি খেতে শুরু করলাম। অর্ধেক খেয়ে আর খেতে পারলাম না। সেদিনের কথা মনে পড়লো। ও আর আমি দুজন মিলে একটা পিজা ভাগাভাগি করে খেয়েছিলাম। ওর অনুরোধে গানও ধরেছিলাম-
মনে রেখো, ভুলে যেও না
এই বিকেলের কথা,
গল্প আমার এখনও অনেক বাকি-
যাবে কি চলে একা...??
মনে রেখো স্বপ্ন ঘেরা সেই প্রথম দেখা
ব্যস্ত রেস্তরার ছোট্ট কেবিনে-
যায় নি ধরে রাখা...
 দুজনার খুনসুটিতে বিকাল গড়িয়ে কখন সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিলো, বুঝতেই পারি নি। ওর ছিলো ফেরার তাড়া। কিন্তু সেদিন আমরা কেউ কাউকে ছাড়তে চাই নি। সেদিন ছিলো আমার বিদায়ের দিন। সেদিনের পর আবার দেখা হবে কি না আমরা কেউ জানতাম না। তাই শেষ মুহূর্তটা দুজনেই অনেক কাছাকাছি থাকতে চেয়েছিলাম। আমরা প্রতিজ্ঞা করেছিলাম কেউ কাউকে ভুলে যাবো না। আমি আমার প্রতিজ্ঞা রেখেছি। কিন্তু ও? কে জানে কোথায় আছে, কেমন আছে? সেদিনের পর আর আমাদের দেখা হয় নি, প্রথম প্রথম কথা হতো। সময়ের সাথে তাও বন্ধ হয়ে গেছে। আমি দীর্ঘশ্বাস চাপলাম। যতই ভাবি ওর কথা আর মনে করবো না, ততই ওকে বেশি করে মনে পড়ে যাচ্ছে।
বিল মিটিয়ে আবারো পথে নামলাম মাথা থেকে ও’র ভূত তাড়াতে পারছি না। সুপার মার্কেটের সামনে এসে নিজের অজান্তেই হাত ঘড়ির দোকানের সামনে এসে দাঁড়ালাম। এটা সেই দোকান, যেখান থেকে ঘড়ি কিনে ওকে গিফট করেছিলাম। ঘড়ি কিনে আমি যখন ওর হাতে পড়িয়ে দিচ্ছিলাম আশেপাশের সব দোকানের লোকজন আমাদের দিকে তাকিয়ে ছিলো। সেদিনের কথা ভাবতে ভাবতে ঘড়ি দেখছিলাম। ফিসফিস করে কেউ বলে উঠলো- “ কেমন আছো সেতু?”
সেতু, নামটা শুনে আমি চমকে উঠলাম। কে ডাকে? কে ডাকে আমাকে এই নামে? পুরো পৃথিবীতে সেতু নামে আমাকে একজনই ডাকতো। আজ আবার এই নামে কে ডাকছে? আমি জিজ্ঞেস করলাম-“ কে ডাকে?” একটা হাত ঘড়ি উত্তর দিলো-“ আমি বলছি।”
-তুমি এই নাম কোথায় পেলে?
-কেনো, তুমি যেদিন এখানে এসে ওর হাতে ঘড়ি পড়িয়ে দিলে, সেদিন তো ও তোমাকে এই নামেই ডাকছিলো।
- ও আবার সেই একই কাহিনী।
-কি হয়েছে সেতু, কেমন আছো তুমি?
- এইতো ভালোই আছি।
- তুমি মিথ্যা কথা বলছো। তোমার চোখ, তোমার মুখ সবাই বলছে তুমি ভালো নেই। কি হয়েছে, বলো আমাদের?
-কিছুই হয় নি। আমি ভালো আছি।
-আচ্ছা, ভালো থাকলেই ভালো।
-ধন্যবাদ।
-একটা কথা জিজ্ঞেস করবো?
-করো।
-তুমি একা কেনো?
আবার সেই একই প্রশ্ন। আমার রাগ চেপে গেলো। চিৎকার করে বলতে লাগলাম- আমি কিছু জানি না। আমি কিছু বলতে পারবো না। প্লিজ তোমারা কেউ আমার কাছে জানতে চেয়ো না, কেনো আমি একা। আমি জানি না আমি কেনো একা...।।
-“ভাই কিছু বলছেন?” দোকানদার এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলো। দোকানদারের কথায় আমি বাস্তবে ফিরলাম। বললাম- “ না ভাই কিছু বলি নাই।”
- আমি দেখলাম আপনি একা একা কি যেনো বলছেন, ঘড়ি দেখাবো? কি ধরনের ঘড়ি দেখাবো বলেন?
- না ভাই, ঘড়ি লাগবে না।
- ঘড়ি লাগবে না, তাহলে দোকানের সামনে অযথাই ভিড় করছেন কেনো? চলে যান, কাস্টমার আসতে দ্যান।
দোকানদারের কথা শুনে আমি পা বাড়ালাম। পেছন থেকে দোকানদারের কথা কানে আসলো-“ কই থেকে যে এইসব পাগল-ছাগল আসে?”
আমি কোনো প্রতিবাদ করলাম না। এক অর্থে তো আমি পাগল’ই। ওকে হারিয়ে সত্যি সত্যি আজ আমি পাগল। সবাই আমাকে পাগল বানিয়েছে। ফুটপাতের গাছ, ধূলিকণা, রেস্টুরেন্টের চেয়ার-টেবিল, দোকানের ঘড়ি সবাই জানতে চায়- কেনো আমি একা? কেনো একা? আমি নিজেও আজ ওর কাছে জানতে চাই- কেনো আমি একা হলাম? কেনো আমি একা? কেনো? কেনো??
আবার ওই কোলে রাখবো মাথা
করো না তো মানা,
অনেক প্রশ্ন আছে জমে
কেবল উত্তর নেই জানা...।।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন