নৈতিক মূল্যবোধ ও আমাদের সমাজ ব্যবস্থা
ইলা মুৎসুদ্দী
নৈতিক চরিত্রের অধিকারী মানুষ দেশ ও জাতির গর্ব।
সত্যকে সত্য বলা, অন্যায়কে অন্যায় বলা এবং ন্যায়-অন্যায় ও সত্য মিথ্যার ভেদাভেদ
বুঝে নিজের মানবিক গুণাবলী দ্বারা সমাজকে আলোকিত করা প্রয়োজন কারণ নৈতিক মূল্যবোধ
ছাড়া মনুষ্যত্ব অর্জন করা সম্ভব নয়। কাজী মোতাহার হোসেন বলেছেনহ “জীবন বৃক্ষের
শাখায় যে ফুল ফোটে, তাই মনুষ্যত্ব।বৃক্ষের গোড়ারয় জল ঢালতে হবে এই ফুলের দিকে
লক্ষ্য করে। শুধু শুধু মাটির রস টেনে গাছটা মোটা হয়ে উঠবে এই ভেবে কোন মালী গাছের
গোড়ায় পানি ঢালে না। সমাজব্যবস্থাকেও ঠিক করতে হবে মানুষকে খাইয়ে দাইয়ে মোটা করে
তুলবার জন্যে নয় মানুষের অন্তরের মূল্যবোধ তথা সৌন্দর্য্য, প্রেম ও আনন্দ সম্বন্ধে
আনন্দ জাগিয়ে তুলবার উদ্দেশ্যে।”
সুশৃংখল নিয়ম দ্বারা নিয়ন্ত্রিত এবং আদর্শ নীতিবোধ,
জীবনচর্চা, নৈতিক মূল্যবোধের অন্তর্গত। নৈতিক মূল্যবোধহীন সমাজ বর্বর সমাজ। নৈতিক
মূল্যবোধের অবক্ষয় অবনতি হলে সেই সমাজের সবকিছু ধ্বংসের প্রান্তে চলে যায়।যার
পরিণতিতে হত্যা, সন্ত্রাস, অপহরণ, নির্যাতন, ছিনতাই, দুর্নীতি বৃদ্ধি পায়। যা এখন
আমাদের সমাজে অহরহ ঘটছে। মানুষের নৈতিকতা, মূল্যবোধ কতটুকু নিষ্পর্যায়ে ধাবিত
হয়েছে প্রতিদিন পত্রিকার পাতা উল্টালে এবং গণমাধ্যমের খবরের শিরোনাম দেখলেই বুঝা
যায়। কেন নৈতিক মূল্যবোধর অবক্ষয় হচ্ছে? তার কারণ বিশ্বজুড়ে পুঁজিবাদের আধিপত্য,
যান্ত্রিক জীবনের গতিশীলতার বিস্তার, একান্নবর্তী পরিবার ভেঙ্গে যাওয়া,
স্বার্থপরতা বৃদ্ধি, শিক্ষাব্যবস্থায় নীতিশিক্ষার অপ্রতুলতা, সমাজের উচুস্তরের
মানুষদের অপরাধসমূহের প্রভাব পরবর্তী প্রজন্মের উপর ভয়াবহভাবে বিস্তার করছে।
উদাহরণস্বরুপ বলা যেতে পারে বর্তমান সময়ে অনেক
ছাত্রকেই পাওয়া যায় যারা শিক্ষকদের প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করেনা। কোথাও দেখা
হলে সালাম বিনিময় পর্য্ন্ত করে না। বয়োবৃদ্ধদের তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে।তাঁদের সামনে
বিভিন্ন নেশাজাতীয় দ্রব্য (পান, সিগারেট)গ্রহণ করে। অসঙ্গতিপূর্ণ কথা বলে। গাড়ীতে
উঠলে দেখা যায়, একজন বৃদ্ধ মানুষ বয়সের ভারে ন্যুজ, দাড়িয়ে থাকার শক্তি নেই, অথচ
উনাকে কেউ সিট ছেড়ে দিচ্ছে না। মা-বাবাকে মর্যাদা দেয় না।
নৈতিক অবক্ষয়ের কারণে আরো জঘন্যতম ঘটনা ঘটছে প্রতিদিন।
মানুষ নামের অমানুষদের কাছে অসহায় হয়ে পড়ছে সমাজের নীতিবান মানুষেরা।
মনুষ্যত্ববোধ, নৈতিক মূল্যবোধ এর অভাবে আজ এরকম পরিস্থিতির শিকার সকলেই। না হলে
কেন ধর্ষকদের হাত থেকে নিষ্পাপ শিশুরা পর্যন্ত রেহাই পাচ্ছেনা। কেন ধর্ষণ করে
হত্যা, জনসমক্ষে এসিড সন্ত্রাস এর শিকার হতে হচ্ছে? এর প্রতিকার কিভাবে হবে?
এরকম নৈতিকতার অভাব এখন আমাদের সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে
ভাইরাসের মত ছড়িয়ে পড়ছে। কলুষিত হয়ে যাচ্ছে সমাজ ব্যবস্থা। প্রতিদিন একটু একটু করে
কলুষিত হতে থাকলে শীঘ্রই অন্ধকারের অতলে হারিয়ে যাব। আমাদের এখুনি সচেতন হওয়া
প্রয়োজন।নৈতিক মুল্যবোধের অবক্ষয় রোধে সমাজের সর্বস্তরে ন্যায় নীতি ও সুশাসন
প্রতিষ্ঠা করতে হবে।ছাত্র সমাজ যাতে উন্নত এবং সুশিক্ষায় শিক্ষিত এবং আদর্শ মানুষ
হিসেবে সচ্চরিত্রের অধিকারী হতে পারে সেইরকম শিক্ষা ব্যবস্থা এবং নীতি শিক্ষার
বিস্তার ঘটাতে হবে। একটি জাতির মধ্যে যখন শৃংখলাবোধ ও সুন্দর মূল্যবোধ গড়ে উঠে,
তখন সেই জাতি মর্যাদাসম্পন্ন জাতি হিসেবে বিশ্বের বুকে মাথা উচুঁ করে দাড়ায়।
আমাদের আছে অনেক মর্যাদাপূরণ ইতিহাস। আমরাও চেষ্টা কররে সততা ও নৈতিক মূল্যবোধকে
কাজে লাগিয়ে মাথা উঁচু করে দাড়াতে পারব। দায়িত্ব, নিষ্ঠা ও শৃংখলাবোধ থাকলে
ব্যক্তিজীবন যেমন সুখকর হয়, তেমনি সমাজজীবনেও আসে সুখ ও সমৃদ্ধি।
বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। গণতন্ত্র রাষ্ট্র
পরিচালনার মূল ভিত্তি। এদেশের মানুষ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য, শান্তি আনয়নের জন্য
দীর্ঘ ৯ মাস যুদ্ধ করে লক্ষ শহীদের রক্তে রাঙা লাল সবুজের স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছে।
অনেক সংগ্রামের বিনিময়ে পাওয়া স্বাধীনতার মর্যাদা আমরা বারে বারে ক্ষুন্ন করছি।জনসম্মুখে
হত্যা, অপহরণ, ছিনতাই, ইভটিজিং এবং এসিড সন্ত্রাসের মত ঘটনা ঘটলেও নিরাপত্তাহীনতায়
ভুক্তভোগী জনগণ নির্বিকার থাকতে বাধ্য হচ্ছে পাছে তারাও একই পরিস্থিতির শিকার হয়
সেই ভয়ে। আর এসবের কারণ একটাই...নৈতিক মূ্ল্যবোধের অবক্ষয়ের কারণে মানুষের মনুষ্যত্ববোধ
লুপ্ত হয়েছে, অসুস্থ মানসিকতার দাপটে খর্ব হয়ে যাচ্ছে সততার নৈতিকতার অগ্রগতি।পরিশেষে
একটা কথা বলতে হয়.....আমরা পারিবারিকভাবে ধর্মীয় নিয়ম কানুন থেকে অনেক দূরে চলে
যাচ্ছি বিধায় নৈতিকতার স্খলন আরো বেশী হচ্ছে। সবারই উচিত হবে প্রত্যেক সন্তানকে
একাডেমিক শিক্ষার পাশাপাশি ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত করা। তাহলে অন্তরে নৈতিক
মূল্যবোধ জাগ্রত হবে। নৈতিক মূল্যবোধ যার মধ্যে জাগ্রত থাকবে সে কখনো অন্যায় কাজ
করতে পারবে না।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন