ছোটগল্প-শিরীন সুলতানা সমপা

এটা গল্প হলেও পারতো

শিরীন সুলতানা সমপা


ইরার সাথে মারুফের পরিচয়টা হলো ডিপার্টমেন্টের প্রথম বর্ষের ছাত্র-ছাত্রীদের নবীনবরণ অনুষ্ঠানের আয়োজনকে কেন্দ্র করে অথচ প্রায় তিনটা বছর একই করিডোর দিয়ে হেটে গেলেও কখনো উনার মুখটা দেখেছে বলেও ইরার মনে পড়লোনা সেমিনারকক্ষে সেদিন অনুষ্ঠানের জন্য নির্বাচিত প্রত্যেক ক্লাস প্রতিনিধিদেরকে নিয়ে ডাকা হোসেন স্যারের মিটিং- সেকথা ইরা মারুফ ভাইকে বলেও ফেললো শুনে উনি হেসে বললেন,'আমিতো তোমাকে চিনি' তা চিনতেই পারেন ইরা যেরকম চঞ্চল আর মিশুক স্বভাবের প্রথম পরিচয়ে মারুফ ভাইকে ইরার যথেষ্ট আত্মকেন্দ্রিক মনে হলো হয়তবা সেইকারণেই উনাকে ইরার সেভাবে কখনো চোখে পড়েনি

কিন্তু অনুষ্ঠানের দিন একেবারেই অন্যরকম মারুফ ভাই যথেষ্ট উৎফুল্ল, অনুষ্ঠানের ফাঁকে ফাঁকে অনেকবারই হাসি-ঠাট্টার ছলে কথা হলো অনুষ্ঠান শেষে অনেকগুলো গ্রুপ ফটোসেশন স্যারদের সাথে,ইরার অনুরোধে একটা ছবিও তুলে দিলেন মারুফ ভাই ইরার দুজনে কথা বলতে বলতে একসাথে কলেজ প্রাঙ্গণও ত্যাগ করলো যাওয়ার সময় একথাও বললেন,'তোমার উপস্থাপনা বেশ ভালো হয়েছে,ইরা' পর্যন্ত সবকিছু ঠিকই ছিল

কিন্তু মনের ভেতর বিপত্তি বাঁধলো তখনই,যখন এরপর থেকে ডিপার্টমেন্টে দেখা হলেও মারুফ ভাই ইরার সাথে কথা বলতেননা কেমন যেন সম্পূর্ণ অপরিচিতের ভান করতে লাগলেন ব্যাপারটা অদ্ভূত মনে হলো ইরার কাছে সদ্য পরিচয় হওয়া কাউকে কেউ এভাবে এড়িযে যেতে পারে? ইরা সেরকম মেয়ে নয় যে, এটা বুঝতে পারার পরও সে যেচে পড়ে কথা বলবে

এভাবে বেশ কিছুদিন কেটে গেলো একদিন আর কৌতুহল মেটাতে না পেরে ইরা মারুফ ভাইকে ডেকে জানতেই চাইলো,আপনি আমার সাথে কথা বলেননা কেন? শুনে উনি মৃদু হাসলেন বললেন,এমনি-আর তুমিওতো বলনা ইরা ভাবলো,এরপর থেকে নিশ্চয় মারুফ ভাই দেখা হলে স্বাভাবিকভাবেই কথা বলবেন

কিন্তু ধারণা হলো ভুল,মারুফ ভাই সেই আগের মতই দেখা হলেও কথা বলেননা একটা মানুষ কথা না বললে কি যায় আসে? তবু একজন পরিচিত মানুষ কোন কারণ ছাড়াই দেখা হলে অপরিচিতের মত আচরণ করছে, ইরা মন থেকে কিছুতেই মেনে নিতে পারছিল না ব্যাপারটা চূড়ান্তভাবে মনে গভীর রেখাপাত করলো ডিপার্টমেন্ট থেকে শিক্ষাসফরে সীতাকুন্ড যাওযার দিন থেকে

সেদিন দুজনের অবস্থান আলাদা বাসে হওয়াতে কথা বলার সুযোগ একেবারেই হযনি ইকো পার্ক,খাবার হোটেলে অনেকবারই দুজনের চোখাচোখি হযেছে ইচ্ছে করলেই কথা বলা যেতো কিন্তু কি যে এক সংকোচের বেড়াজাল ইরাকে ঘিরে রেখেছিল মারুফ ভাইকে কেমন বিষন্ন দেখাচ্ছিল,একা একা ঘুরছিলেন ইকো পার্কে এই ব্যাপারটা ইরার চোখ এড়িয়ে যায়নি তারপর,যা হওয়ার কথা-ঠিক তাই হলো ইরার ভাবনা অন্যদিকে মোড় নিলো

মারুফ ভাইকে দেখলে ইরাও এখন এড়িয়ে চলে দেখলেও এমন ভান করে,যেন চিনেইনা সদা চঞ্চল ইরা প্রতিদিন কলেজে আসে বিমর্ষ মনে ক্লাসে খুব প্রয়োজন ছাড়া কারো সাথে কথাও বলেনা এভাবে প্রায় একমাস পার হয়ে গেলো মনের উপর প্রচন্ড চাপ পড়ছে,বেশ বুঝতে পারছে ইরা কাছের কোন বন্ধু-বান্ধবকে বলার সাহসও পাচ্ছেনা যদি হিতে বিপরীত হয়! এমনওতো হতে পারে,মারুফ ভাইয়ের মনে কিছুই নেই উনি সত্যি হয়তবা এমনিতেই ইরার সাথে প্রয়োজন নেই বলে কথা বলেননা আর ইরা কিনা উনাকে নিয়ে একাই ভেবে যাচ্ছে !

সাদেক ভাই,সবসময় ইরার সাথে খুব মজা করে কথা বলেন সবার সাথেই উনি মিশেন,দুষ্টমি করতে পছন্দ করেন ইরা খেযাল করেছে,মারুফ ভাই-এর সাথেও উনার সম্পর্কটা মোটামোটি-তবে ঠিক বন্ধু নয় ইদানীং যে ইরা খুব চুপচাপ থাকে কলেজে,এটা সাদেক ভাইয়ের চোখ এড়িয়ে যায়নি কোন কথা বললেও আগের মত সেভাবে উত্তর দেযনা একদিন একা পেযে ইরাকে খুব চেপে ধরলো সাদেক ভাই এমনভাবে উনি জানতে চাইলেন ইরার কাছে,ক্ষণিকের দূর্বলতায় মনের চাপ আর ধরে রাখতে না পেরে সব খুলে বললো ইরা সাদেক ভাইকে কিন্তু কথাও আদায় করে নিলো ইরা,কাউকে বলবেন না উনি সে কথা কিন্তু সাদেক ভাই কথা রাখলেন না

তার দুইদিন পর ক্লাস শেষ করে ইরা বাসায় ফিরবে বলে কলেজ থেকে বের হয়ে গেলো কিন্তু হঠাৎ ইচ্ছে করলোনা বাসায় ফিরতে এক বান্ধবীকে খুঁজতে ওর মেসে গেলো সেখানে না পেয়ে আবার কলেজে ফিরে আসলো অন্য ডিপার্টমেন্টের দিকে যাচ্ছিল,হঠাৎ পেছন থেকে ডাক ! তাকিয়ে দেখলো,মারুফ ভাই ! বললেন, অনেকক্ষণ থেকে তোমাকে খুঁজছি,তোমার সাথে কথা ছিলো ধ্বক করে উঠলো ইরার বুক ! তবে কি সাদেক ভাই সব বলে দিলো? কি বলবেন উনি এখন ইরাকে?

দুজন হাটতে হাটতে কলেজ পেরিয়ে রেললাইনের পারে চলে গেলো সেখানেই ছায়া খুঁজে নিয়ে এক জায়গায় বসলো আমি তোমার সাথে কেন কথা বলিনা, এড়িয়ে চলি-সত্যি জানতে চাও? ইরা পুরো চোখ মেলে তাকালো মারুফ ভাইয়ের দিকে মারুফ ভাই বলতে লাগলেন,আমিতো অনুষ্ঠানের দিন থেকেই তোমাকে নিয়ে অন্যকিছু ভাবতে শুরু করেছিলাম ভেবেছিলাম -তুমিই হয়তো........ আচ্ছা,তুমি এতদিন আমাকে কিছু বললেনা কেন,ইরা? আমারওতো সেই ভয় ছিল, আপনি যদি আমাকে.....! দুজনেই একসাথে হেসে ফেললো

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন