আঁধারভীতি
মোহাম্মদ ইসহাক খান
আমি অন্ধকার ভয় পাই।
শুধু ভয় পাই বললে ভুল
বলা হয়। ঠিকমতো বোঝানোর জন্য এতটুকুই যথেষ্ট হবে যে, আমি রাতে ঘরের বাতি নেভাই না।
সারারাত আমার শোবার ঘরের বাতি জ্বালানো থাকে। বাতি যতক্ষণ জ্বালানো থাকে, ততক্ষণ
মনে হয় আমি নিরাপদ। কিন্তু নেভালেই যত সমস্যা শুরু হয়। যখন অন্ধকার নেমে আসে, তখন
মনে হয় দেয়ালে পড়েছে কিছু রহস্যময় ছায়া। মনে হয় ঘরের লাগোয়া বারান্দায় কেউ পা টিপে
টিপে হাঁটছে। মনে হয় বাথরুমে কেউ লুকিয়ে আছে, পানির কল ছাড়ছে আর বন্ধ করছে। মনে হয় বিছানার নিচে কেউ ঘাপটি মেরে বসে আছে। মনে
হয় জানালা দিয়ে এই বুঝি কেউ ঢুকে পড়লো, আমার গলা টিপে ধরল। মনে হয় ঘাড়ের কাছে কেউ
গরম নিঃশ্বাস ফেলছে।
নিতান্ত সাধারণ শব্দগুলো
রাতে খুব ভয়ের হয়ে আমার কাছে দেখা দেয়। আমি ছাড়া এই ফ্ল্যাটে আর কেউ থাকে না,
কিন্তু স্পষ্ট শুনতে পাই ডাইনিং রুমে কেউ একজন গ্লাসে পানি ভরছে, ঢকঢক করে পানি
খাচ্ছে। ভয়ে আমার সারা শরীর অবশ হয়ে আসে। আমার হৃদস্পন্দন বেড়ে যায়, চাদরের নিচে
কুলকুল করে ঘামতে থাকি, হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে আসে। সারারাত দু'চোখের পাতা এক করতে
পারি না। প্রাণপণ চেষ্টা করি পা থেকে মাথা পর্যন্ত চাদর মুড়ি দিয়ে ঘুমোতে, কুণ্ডলী
পাকিয়ে শুয়ে থাকি শিশুর মতো। কিন্তু ঘুম আসে না, বরং সারারাত এভাবে শুয়ে থেকে
পেটের কাছে ব্যথা হয়ে যায়।
যখন সকাল হয়, ছ'টা কিংবা
সাতটা বাজে, তখন সূর্যের আলো আমার ঘরে ঢোকে, কৃত্রিম আলোর উৎসটি বন্ধ করে দিয়ে আমি
স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলি।
ডাক্তারদের পরামর্শ
অনুযায়ী সঠিকভাবে ঘুমের কিছু নিয়মাবলী আছে (কেতাবী কথা!) । সেগুলো হল, শোবার ঘর একদম অন্ধকার
হতে হবে, কোন কোলাহল থাকা চলবে না। ঘর প্রশস্ত হতে হবে, খোলামেলা হতে হবে। প্রচুর
বায়ু চলাচলের রাস্তা থাকতে হবে। শোবার ঘরে কোন আসবাবপত্র থাকা চলবে না, এই ঘর
ব্যবহৃত হবে ঘুম এবং কেবলমাত্র ঘুমের জন্য। ঘরের দক্ষিণ পার্শ্বে বড় জানালা থাকতে
হবে। শোবার ঘরে আলো থাকলে মস্তিষ্কের ঘুম ও অবচেতন মনের তথ্য সন্নিবেশনে সমস্যা
হতে পারে, দীর্ঘ মেয়াদে ত্বকের ক্যান্সার দেখা দিতে পারে, ইত্যাদি ইত্যাদি।
এসব নিয়মাবলী যে মেনে
চলার চেষ্টা করি না তা নয়। কিন্তু বড় বড় কয়েকটা শর্ত পূরণ করতে পারি নি। জানালা
সবসময় বন্ধ রাখি, খোলা রাখতে সাহস হয় না। কেউ যদি অন্ধকারে ঘরে ঢুকে পড়ে, জবাই করে
ফেলে? আর নিশ্ছিদ্র অন্ধকার? বলেছিই তো, একশো পাওয়ারের একটা আলো জ্বলে, কোন
অন্ধকার যেন ঘরের কোণে জমে থাকতে না পারে, তা নিশ্চিত করার জন্য। কড়া আলোর মধ্যে
থাকার কারণে ঘুমের আরও ব্যাঘাত হয়, কিন্তু আমি নিরুপায়।
রাতের পর রাত ঠিকমতো ঘুম
হয় নি। শান্তির ঘুম কাকে বলে ভুলে গিয়েছি। ঘুম হয় খুব ছাড়া ছাড়া। চোখের নিচে গভীর
হয়ে কালি পড়ে গেছে আমার। মুখে এসেছে ছন্নছাড়া ভাব। বন্ধুবান্ধব দেখে চমকে উঠেছে।
জিজ্ঞেস করেছে, কী হয়েছে তোর? ভূতের মতো চেহারা কেন? গাঁজা খাচ্ছিস, নেশা করছিস?
চোখ লাল কেন?
আমি জবাব দিতে পারি নি।
আমি লাজুক নই, এমনিতে ভীতুও নই। কিন্তু কেন আমার এই অবস্থা, কাউকে বলতে পারিনি।
যদি হাসাহাসি করে? তখন আমার খুব খারাপ লাগবে। কী অবস্থায় দিন কাটাচ্ছি, আমিই জানি।
কাউকে বলিনি, কথাটা ঠিক
নয়। একজন মানুষ যতই সাহসী হোক, তার মধ্যে ভয় থাকবেই। কিছুটা হলেও, এক চিলতে হলেও
থাকবে। যার মধ্যে কোন ভয় নেই, সে স্বাভাবিক মানুষ নয়। সাহসী মানুষেরা ভয়ের মধ্যেও
মাথা ঠাণ্ডা রাখে বলে বিপদআপদ এড়াতে পারে; আর যাকে সবাই ভীতু বলে জানে, সে বিচলিত
হয়ে পড়ে বলে উল্টোপাল্টা কাণ্ড করে বসে। আমার সমস্যার কথা একজন পরিচিত ডাক্তারের
কাছে বলেছি। তিনি বলেছেন, এটা একেবারে বিরল কেস নয়, অনেকের মধ্যেই আঁধারভীতি থাকে।
আমার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা একটু বেশি। তিনি আমাকে "বুকে সাহস" রাখতে
বলেছেন। "আশ্বাস" দিয়েছেন, সময়ের সাথে ভয়টা একেবারেই কেটে যাবে, আমি
আবার স্বাভাবিক হয়ে যাবো।
এই মুস্কিল আসানের
কয়েকটা উপায় বাতলে দিয়েছেন তিনি। বলেছেন, রাতের অন্তত একটি ঘণ্টা বাতি নিভিয়ে
থাকতে। কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার মতো ব্যবস্থা, অন্ধকার দিয়ে অন্ধকারের ভয় কাটানো। এক ঘণ্টা আঁধারে কাটাতে
পারলে যখন আমি দেখবো যে বিপদ বা ভয়ের কিছুই নেই, তখন আমার অবচেতন মন
ধরে নেবে যে আরও এক ঘণ্টা আঁধারে কাটানো যায়! এভাবে আমি ধীরে ধীরে সহজ অবস্থায়
ফিরে আসবো, এবং সারারাত বাতি নিভিয়ে ঘুমোতে পারবো। মাকড়সাভীতিতে আক্রান্ত রোগীর
গায়ে মাকড়সা ছেড়ে দিয়ে বোঝানো হয় যে এটি অতি নিরীহ প্রাণী, ব্যাপারটা অনেকটা সে
রকম।
ডাক্তার আঙ্কেলের কথামতো
চেষ্টা করে দেখেছি। কিন্তু কাজ হয় নি। দু মিনিটের মধ্যেই সিঁটিয়ে গেছি ভয়ে। আবার
বাতি জ্বালাতে হয়েছে, এবং তীব্র আলোতেই ঘুমোবার চেষ্টা করতে হয়েছে। বিছানাকে এখন
আর আরাম এবং বিশ্রামের উষ্ণ আশ্রয় বলে মনে হয় না, মনে হয় কবরখানা, গারদ জাতীয়
কিছু। সকাল হলেই আবার সব স্বাভাবিক, কারণ দিন মানেই তো আলো।
আমি বিজ্ঞানের ছাত্র।
সবকিছু যুক্তি দিয়ে বিচার করতে শিখেছি ছোটবেলা থেকেই। কার্যকারণে বিশ্বাস করি।
আমার সাথে খানিকক্ষণ কথা বললে যে কেউ আমাকে একজন স্বাভাবিক যুক্তিবাদী মানুষ বলেই
ধরে নেবে। কিন্তু রাতে অন্ধকারে অহেতুক ভয়ে ছটফট করা দেখে সবাই আমাকে নেহায়েত পাগল
ঠাউরাবে, আমি নিশ্চিত।
*****
এখন রাত। আমি আবার
ঘুমোবার ব্যর্থ চেষ্টা করে যাচ্ছি। চাদর মুড়ি দিয়ে নিজেকে ঢেকে ফেলেছি (নিজেকে
রক্ষার একটি কৌশল বা Defence Mechanism. বিপদে মানুষ চায় চোখ বন্ধ করতে, নিজেকে
লুকোতে, ঢেকে ফেলতে, কুণ্ডলী পাকিয়ে শরীরটাকে সামনের দিকে গুটিয়ে ফেলতে, হাত
সামনের দিকে বাড়িয়ে বিপদের বস্তুটিকে ঠেকাতে ইত্যাদি), শুধু দুই চোখ বের করে আছি
আর আমার অতি পরিচিত ঘরের চারপাশে সন্তর্পণে চোখ বুলিয়ে যাচ্ছি, রাত হলেই যে ঘর
অচেনা হয়ে আমার সামনে দেখা দেয়।
ঘরে আলো জ্বলছে,
বারান্দাতেও। কিন্তু আমার ভয় কাটছে না। কয়েকদিন ধরে সময়ের সাথে ভয়টা বেড়ে চলেছে।
রাত বাড়ে, সেই সাথে ভয়টাও বাড়ে। ভয় বুঝি একটা জীবিত প্রাণী, সে এক জায়গায় স্থির
হয়ে বসে থাকে না, নিজেকে বিস্তার করে চলে, শাখাপ্রশাখা ছড়িয়ে দেয়। আমার সারা শরীর
এবং অন্তঃকরণকে গ্রাস না করা পর্যন্ত বুঝি ক্ষান্ত দেবে না।
এই ক'দিন তবুও ভালোই
ছিল। কিন্তু আজ হঠাৎ করে মাঝরাতে কারেন্ট চলে গেল।
আমার শিরদাঁড়া বেয়ে একটা
শীতল স্রোত বয়ে গেল। আমি অবশ্য সম্ভাব্য বিপদের জন্য প্রস্তুত ছিলাম, আমার মাথার
কাছে ছোট্ট টেবিলটাতে রাখা আছে টর্চ, মোমবাতি, দেশলাই। একটা কাজ না করলে আরেকটা।
বলা তো যায় না, যদি এক রাত অন্ধকারে থাকতে হয়, তাহলে ভয়ে হয়তো দরজা খুলে বাইরে ছুট
লাগাব কিংবা পুরোপুরি পাগল হয়ে যাবো।
আমি হাত বাড়াতে টর্চটা
হাতে ঠেকল। আহ, বাঁচা গেল।
কিন্তু সুইচ টিপলেও কোন
আলো জ্বলল না। সর্বনাশ! এতদিন ব্যাটারি ছাড়াই টর্চ মাথার কাছে রেখে চলেছি!
আমি টর্চ রেখে মোমবাতির
দিকে হাত বাড়ালাম। ঘুটঘুটে অন্ধকার, আমাদের পাড়ায় কোন জেনারেটর নেই বলে পুরো এলাকা
ডুবে গেছে কালিগোলা আঁধারে।
হাত মোমবাতিতে স্পর্শ
করলো, কিন্তু ভাগ্য বুঝি আমার সাথে আজ মশকরা শুরু করেছে, হাতের ধাক্কায় মাটিতে পড়ে
গেল ওটা। আরও মজার (নাকি ভয়ের?) ব্যাপার, দেশলাইটাও গা ঢাকা দিয়েছে। টেবিলে
রেখেছিলাম তো?
আমি দম বন্ধ করে নিচু
হলাম, হাতড়াতে শুরু করলাম মেঝে। দেশলাইটা কাছাকাছিই পড়েছে, পেয়ে গেলে একটু আলো
জ্বালাতে পারবো। শরীর জমে যাচ্ছে আমার। শীতে নয়, ভয়ে।
কান পেতে আছি আমি। চোখ
কাজ করছে না বলে কানই ভরসা। বাথরুমের একটা পানির ট্যাপ ঠিকমতো বন্ধ হয় না, টিপটিপ
করে পানি পড়ছে ওটা থেকে, নিঝুম রাতে স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি আমি। কেমন বিদঘুটে আওয়াজ
পানি পড়ার!
হাত ঠেকল শীতল কিছু
একটাতে। মানুষের হাত না তো? চিৎকার করে হাত সরিয়ে নিতে গিয়েই বুঝলাম যে মেঝেতে
রাখা ঘরে পরার স্যান্ডেলটাতে হাত ঠেকেছে। তারপরও হাতড়ে হাতড়ে নিশ্চিত হয়ে নিলাম।
মোমবাতি কিংবা দেশলাই,
কোনটাই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আমি দশ মিনিট ধরে খুঁজে ক্ষান্ত দিলাম। বোধহয় গড়িয়ে
চলে গেছে খাটের ভেতরের দিকে, অথবা হাতের নাগালের বাইরে। বিছানা থেকে নামার সাহস
নেই। বাইরে যেতে হলে আমাকে দুটো বড় ঘর পার হতে হবে, দরজা খুলে সিঁড়ি বেয়ে নিচে
নামতে হবে। তার আগেই হয়তো ... ...
আমার হাত আর পায়ের তালু
ঘামছে খুব, কিন্তু আমি চাদর গায়ে ভালোমতো পেঁচিয়ে বসে আছি বিছানায়। দমকা বাতাসে
দুলছে জানালার পর্দা, আর আমি চমকে চমকে উঠছি। কপাল ঘামা শুরু হয় নি এখনো, শুরু হলে
বুঝতে হবে ভয়টা সহ্যের মাত্রা অতিক্রম করেছে। নাকের ওপর নোনা ঘামের বিন্দু জমে উঠছে,
টের পাচ্ছি।
বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে
কে ওটা? ঠিক একজন দণ্ডায়মান দীর্ঘাকৃতি মানুষের মতো, সিগারেট খাচ্ছে। ঐ তো ধোঁয়া
উড়ছে। আমি মৃদু স্বরে ডাকলাম, কে? নিজের গলার স্বর নিজের কাছেই অচেনা ঠেকল, ভয়ে
বিকৃত হয়ে গেছে।
সদর দরজায় মৃদু আওয়াজ
হচ্ছে। কেউ দরজা ধাক্কাচ্ছে। এত রাতে কে আসবে? ভুল শুনছি আমি, নিশ্চয়ই ভুল শুনছি।
ড্রয়িং রুমে কার মৃদু
হাসির শব্দ? খোদা, আর তো সহ্য হয় না।
কারেন্ট আসে না কেন? আমি
অস্থির হয়ে বসে আছি, আবার আলো জ্বলার অপেক্ষায়।
ঘড়ি চলছে টিক টিক, টিক
টিক, টিক টিক। আমার কাছে কেন যেন মনে
হচ্ছে, ঘড়ির শব্দটি অনিয়মিত, যেন ঠিকমতো সময় পার হচ্ছে না,
হঠাৎ করে থেমে যাচ্ছে, আবার চালু হচ্ছে।
*****
এই আমার ভয়ের গল্প। এই
গল্পে কোন ভূত নেই, অশরীরী আত্মা নেই, একটি ভয়ের গল্পে যা যা দরকার হয়, বলতে গেলে
তার কিছুই নেই। যেটুকু আছে, তা নিখাদ ভয়। আমার
নিজের ভয়। ব্যক্তিগত ভয়। আঁধারের ভয়, যা পূর্বপুরুষ থেকে রক্তে চলে এসেছে, আর আমার
মধ্যে অতি প্রবল হয়ে উঠেছে, আমাকে অস্থির আর ক্ষ্যাপা করে তুলেছে। যা কেউ বুঝবে
না, যতক্ষণ না এই ভয় তার নিজের মনে জন্ম নেয়, দানা বেঁধে ওঠে।
[আঁধারভীতি (Nyctophobia) বলে একটি বিষয় সত্যিই
আছে। শিশুদের মধ্যে এটি বেশি দেখা যায়। তবে প্রাপ্তবয়স্ক অবস্থাতেও কয়েকটি
ক্ষেত্রে অন্ধকারে অস্বাভাবিক ভয় লক্ষ করা যায়, যার সংখ্যা কম। স্বাভাবিকভাবেই রাতের
বেলায় এই ভয় প্রবল আকার ধারণ করে থাকে। বিনীত - মোহাম্মদ ইসহাক খান।]
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন