কবিতা-ডঃ সুজাতা ঘোষের ৪'টি কবিতা

তুমি কি জানো?

ডঃ সুজাতা ঘোষ


হাতের উপর হাত রাখ, অনুভব কর আমায়
সেদিন কাজের ব্যস্ততায় তোমার হাত আমার আঙুল
ছুঁয়ে গেছিল বারবার
আমি শিহরিত হয়েছি কতবার, জানো?
হঠাৎ করে চোখ আটকে যায় অজান্তে
তোমার দৃষ্টি থমকে যায় আমার মুখের উপর,
তাকি তুমি নিজে বোঝ?
সেদিন করিডোরে দৌড়ে যেতে গিয়ে
দমকা হাওয়ায় টান পড়েছিল আমার ওড়নায়
তুমিও তো দাঁড়িয়েছিলে খুব দূরে নয়,
তবে কেন খুঁজতে হয় তোমাকে আমায়?
তোমার কালো জামার পারফিউমটা এখনো আমার বুকে লেগে,
স্নানঘরে ভালোলাগাটা ছড়িয়ে পড়ল চারপাশে
তুমি কি জান?
সেদিন প্রচণ্ড রেগে গিয়ে চিৎকার করছিলে
সমস্ত রাগ ঘাম হয়ে ভেসে উঠেছিল গলায় আর বুকে,
আমি তাকিয়েছিলাম অনেকক্ষণ
ভীষণ সুন্দর লাগছিল দেখতে তোমায়
তুমি ভীষণ রকম পুরুষ হয়ে উঠেছিলে, যেমন নারী চায়
তুমি তো সব বোঝ, তাই না?
শুধুমাত্র না বোঝার অভিনয় করো
নাহলে, ঘুমন্ত আমাকে নিজের গরম জামা দিয়ে
ঢেকে দিলে কেন আলতো করে?
আমি বুঝেছিলাম, ভালোলাগাটা তুমিই
তোমার প্রচণ্ড গম্ভীর স্বর প্রতিধ্বনিত হতে থাকে হাওয়ায়,
হাওয়া ছুঁয়ে যায় আমার সমস্ত ভালোলাগা আর শরীর
যেদিন তোমার পুরু ঠোঁট দুটো প্রথম ছুঁল
আমার ঠোঁট, গলা, কাঁধ,
সেদিন হঠাৎই সকাল হয়েছিল খুব তাড়াতাড়ি
খুব ভালো লেগেছিল স্বপ্নের সারারাত
তুমি কি জানো?
কি করে বলি তোমায়
কিন্তু আমি জানি, তুমি সব বোঝ
সব অনুভব কর আমারই মত
একবার হাতের উপর হাত রাখ,
অনুভব কর আমায়।।





আমি তো অসহায় রাস্তা মাত্র

ডঃ সুজাতা ঘোষ


ওফ অসহ্য গরম, মানুষগুলো একটু জলও ঢালে না
পিচটাও গলতে শুরু করেছে,
কেমন যেন চ্যাটচ্যাটে ভাব একটা
দুধারের দোকানীরা প্রায় পাত্তারি গুটিয়ে ফেলেছে
গুটিকতক মানুষ ছাতা মাথায়
এসময় ভাগার মালটাও সস্তায় পাওয়া যায়
কুকুরগুলো জিভ বের করে দৌড়চ্ছে দিশাহীন

একটা পাগল হাতে লাঠি নিয়ে ঘুড়ছে, 
আশপাশের মানুষগুলো ভয়ও পায় না, দেখে
হঠাৎই বড় মাপের বুটটা তাল সামলাতে পারে না,
মুখ থুবড়ে পড়ে যায়, ছিটকে যায় হাতের লাঠি
দোকানের মানুষগুলো চায়ে চুমুক দিয়ে বলে,
ওঠ, ওঠ, আস্তে আস্তে ওঠ, পারবি ঠিক ...............
কেউ এগিয়ে আসে না,
ওরা কি ঘৃনা পায় নোংরা জিনিষ ধরতে!

এখনই সন্ধ্যা হল নাকি?
না, ঝড় উঠবে মনে হয়, বাঁচা গেল
জল দাও ঠাকুর, একটু জল দাও
শরীরটা একটু জুড়োক
ভাবতে না ভাবতেই ঝমঝমিয়ে নামল মেঘরানী
ওফ কি জ্বালা, একটু শান্তি নেই গো?
কে দৌড়য় আমার বুকের উপর দিয়ে?
আরে আরে ছেড়ে দে, ওকে যেতে দে ঘরে
আর সহ্য হয় না আমার, ফাঁকা বাদলা রাস্তা ............
দিল শেষ করে মেয়েটাকে, শয়তানগুলো মিলে
থু

এখন কটা হবে? মনে হয় সাড়ে বারো
লোক আস্তে আস্তে কমছে, গরম মাথায় উঠছে
অটোগুলো এত জোরে যায় না!
আরে আরে, ধর ধর ধর , কেউ তো ধর
আহা রে, মেয়েটা সবে মাত্র বসেছে রিক্সায়
বজ্জাত অটোগুলো, রোজ কাউকে না কাউকে মারবেই
কত সুন্দর ফুলের মত মেয়েটা পড়ল মুখ থুবড়ে,
আমার বুকের উপরই তো লাগল
মনে হয় হাড়গোড় সব ভেঙেছে 
উঠতেও পারছে না, ওর বুকের ওঠানামা
অনুভব করতে পারছি আমি

এই মানুষগুলো কি?
সব দৌড়ে এসে ঘিরে দাড়িয়ে আছে
একটাও কি পুরুষ নেই, হাত বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য!
দেশটার হল কি?
আরে মেয়েটাকে তুলে হাসপাতালে নিয়ে যা
আমি আর পারি না, চেঁচাতে চেঁচাতে গলা গেল

হায় ঈশ্বর, মেয়েটাকে ওঠার শক্তি দাও,
নাহলে পুরুষগুলোকে পুরুষত্ব দাও
চোখের জলে আমার দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসছে
মেয়েটা উঠছে, নিজেই নিজের শক্তি হয়ে
এক ঝলক তাকাল ঘৃনার দৃষ্টিতে ...............
একটা মানুষও হাত বাড়ায় নি তাকে টেনে তুলতে;
অথচ ভিড়ে, ফাঁকা রাস্তায়, অন্ধকার গলিতে,
বাসে, ট্রামে, ট্রেনে ..................... এমনকি অটোতেও;
কত হাত লুকিয়ে, শরীরের আনাচে কানাচে
ছুঁয়ে ছুঁয়ে চলে যায়, রাজ্য জয়ের উল্লাসে

আমি তো শুধু দেখি আর কাঁদি
মানুষগুলো কি কাঁদতেও ভুলে গেছে নাকি!
নাকি অভ্যস্থ হয়ে পড়ছে সমস্ত দুর্ঘটনার সাথে?
ওই তো, ওই তো আবার কিছু একটা হতে চলেছে ...............
আর সহ্য হয় না আমার, আমায় দুটি হাত দাও
হে ঈশ্বর, আমায় দুটি হাত দাও;
রোজ রোজ এই লজ্জা চোখের পাতা খুলে দেখার মত
মনের জোর আর নেই আমার
বয়সের ভারে সারা শরীরে ছোট বড় গর্ত, ভাঙাচোরা
তার উপর কেউ না কেউ উল্টে পড়ছে, রক্ত ঝরছে ...............
কারোর উপর আবার অনেকে মিলে ঝাপিয়ে
শেষ করে দিচ্ছে একটু একটু করে ........................
এবারে দুচোখ ঢাকতে চাই আমি;
আমি তো অসহায় রাস্তা মাত্র ..................!





ভালো থেকো মা

ডঃ সুজাতা ঘোষ


অনেকগুলো মেঘ জড়ো হলো কাছাকাছি 
চারদিকে সাদা ঘোলাটে হতে না হতেই
দুএক ফোঁটা নাকে মুখে ছুঁয়ে গেল
মাটির সোঁদা গন্ধ পাক খাচ্ছে হাওয়ায়
আর একটু অপেক্ষা করলেই শান্তি

অনেকক্ষণ আগে ওরা আমাকে ফেলে দিয়ে গেছে, 
প্রয়োজনবোধ করেনি মাটি চাপা দেওয়ার, 
প্রয়োজনবোধ করেনি নাকের শ্বাস ছুঁয়ে দেখার, 
যখন মনে হয়েছে আর দরকার নেই
তখনই ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে গেছে মাটির উপর

সন্ধ্যে হতে এখনো অনেক দেরী
অন্ধকার হয়েছে ঝড় ওঠার জন্য
কারোর সময় নেই ফিরে তাকানোর
আমার মা আমাকে শরীর থেকে
ছিন্ন করেই আর এক মুহুর্ত সময় নষ্ট করে নি

আমি বেশ হাতপা নাড়ছি এখনো
কুকুরগুলো আমার সারা শরীর জিভ দিয়ে
চেটে চেটে লালায় ভরিয়ে দিয়ে গেছে
অচেনা অনুভূতি নড়েচড়ে বেড়াচ্ছে সারা শরীরে
আমি তো জানিনা, মা কেমন করে আদর করে !

পিঁপড়া ছেকে ধরেছে সারা শরীরে
আমি যন্ত্রণায় ছটফট করে হাত - পা দাপাচ্ছি
গায়ে বৃষ্টি পড়ছে বেশ জোরে
ঠাণ্ডায় কিছুটা জ্বালা জুড়াচ্ছে
আমার আর শ্বাস নেওয়ার ক্ষমতা নেই
বেশিক্ষণ আর দেখতে হবে না এই তোমাদের
শেষ হচ্ছি খুব আস্তে

মা, ভালো থেকো
আমি চলে যাচ্ছি পৃথিবী ছেড়ে
তোমাকে ছেড়ে বহুদূর
মাটির সোঁদা গন্ধ হারিয়ে দিয়েছে
তোমার শরীরের রক্তের গন্ধ

কোনদিন যদি মনে না পরে ভুলেও
শেষদিন মনে পড়বে নিশ্চয়ই
এই মাটিতেই শেষ হবে তোমার শরীর
সেদিন মিশব তোমার সাথে
কেউ আমাকে ছিনিয়ে নিতে পারবে না মাগো,
তোমারও দরকার হবে না মুখ লুকানোর
সেইদিন আমি ঘুমাব তোমার কোলে
আজ বিদায়, ভালো থেকো মা।।




একছুটে .... সুমেরু

ডঃ সুজাতা ঘোষ


যখন পৌঁছলাম মানব সভ্যতার শেষ আলো পেড়িয়ে;
সামনেই শিতল জলতরঙ্গ,
নেচে নেচে আহ্বান করে গেল সাদা সূর্যের দেশে
সূর্যের আলোর রঙ কি তবে সত্যিই সাদা?
চতুর্দিকে ঢেউ তুলে দাড়িয়ে শুভ্র শীতল শৃঙ্গ!
একি রূপ তোমার পৃথিবী? 

দৌড়ব না হাঁটব? নাকি সাঁতার কাটব গলে যাওয়া বরফে!
ইচ্ছা হয় দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরি দুহাতে
ইচ্ছা হয় একছুটে পৌঁছে যাই শৃঙ্গে
ইচ্ছা হয় দুহাত ছড়িয়ে হেঁটে বেড়াই পেঙ্গুইনদের সাথে
মনে হয় সাদা ভাল্লুকগুলোর সাথে বরফ বল খেলি

এত রূপ তুমি লুকিয়ে রাখ কি করে, পৃথিবী? 
তোমার রঙ মেখে সাদা পরী হতে চাই আমি,
নতোবা সাদা প্রজাপতি
চিৎকার করে গান করতে চাই একবার,
চিৎকার করে জানাতে চাই,
ওগো শুনছ, ভালবাসি আমি তোমায়
যা বলতে পারিনি বহু বছরেও

শেষ বিন্দুতে দাঁড়িয়ে একবার দুহাত ছড়িয়ে,
শ্বাস নিতে চাই আমি চোখ না খুলে
হারিয়ে যেতে চাই আমি নীলাকাশে
ওখান থেকে সূর্য কত দূর?
অথবা ধ্রুবতারা?
তুমি দেখতে আমায় শোওয়ার ঘরের জানলা থেকে!
তুমি তো হারিয়ে ফেলতে চেয়েছিলে আমায়,
আমি ধ্রুবতারার হাত ধরতে পারি ইচ্ছা হলে,
জান কি তুমি?

চাঁদও পাক খেয়ে যায় আমায়, আর হাসে
চাঁদ কেন হাসে অকারণে? 
একদিন রাগ করে জিজ্ঞাসাও করেছিলাম;
হেসে বলেছিল, সুমেরু গলছে, বাড়ি যাও ............
তো আর খবর পড়ে না, কি করে জানবে,
দু বছরে আরও অনেক বরফ জমেছে পাহাড়ের গায়ে

এই পাহাড়ের ভিতর অনেক ধনরত্ন ঘুমিয়ে আছে শান্তিতে
ভাগ্যিস মানুষের হাত পড়েনি!
মানুষ তো কাছেই যেতে পারে না, চাই ভেঙ্গে ঘাড়ে পড়ার ভয়ে
সত্যিই, সুন্দর যে এত ভয়ঙ্কর হতে পারে, ভাবা যায় না
আমি তো ভাবছি, কিছুকাল এখানেই কাটিয়ে যাব
তুমিও চাইলে আসতে পার,
আমরা বরফের ঘর বানাব
রাগ করলে তো? জানি;
কতবার বলেছি, ল্যাপটপটা সরাও, ফোনটা ছুড়ে ফেল,
ট্যাবটা ফ্ল্যাশ করে দাও
ড্রাইভারের সিটে শক্ত করে বেল্টটা বেঁধ না,
অতগুলো ওষুধ নিয়ম করে না খেয়ে, একটু জোরে শ্বাস নাও তো!
শুনবে না, আমার কোন কথাই শুনবে না

তাই তো চলে এলাম এতদূরে, সবকিছু ছেড়ে
এখানে কত শান্তি, কত আলো!
একা একা ছুটে বেড়াচ্ছি পাহাড় থেকে পাহাড়
তুমি যদি হাতটা ধরতে, তাহলে বুঝতে কি আনন্দ!
আমি ছুটছি আর ছুটছি
কত বরফ গায়ে মাখলাম, হাসতে হাসতে ক্লান্ত
ক্লান্তিতে আমার দুচোখ বেয়ে জল নামছে
আমি কি কাঁদছি?

তোমাকে ছাড়া সবকিছুই একঘেয়ে লাগে
তোমার হাত ধরেই ছুটতে চাই আমি
তোমার কাঁধে মাথা রেখে নিশ্চিন্তে বসব লেকের ধারে
তোমার আঙ্গুল ছুঁয়ে হেঁটে যাব ঘাসের উপর দিয়ে
তোমার বুকে নিশ্চিন্তে মাথা রেখে
ঘুড়ব সুমেরু, কুমেরু, চাঁদ, সূর্য, তারা
চলো যাই একছুটে সুমেরু, তোমার হাত ধরে ।।