বর্ষা ও একটি কাঠ পেন্সিল
শোয়েব সাইফী
মেহের ছাদের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে।
মনটা তার সামান্য বিক্ষিপ্ত। মনের এই
বিক্ষিপ্ত ভাব ভুলে থাকতেই এভাবে দাঁড়িয়ে থাকা। ছাদ থেকে কিছুটা দূরে একটি লাল
র্সূয। র্সূযটা মেঘর সাথে লুকোচুরি খেলছে। মেহের তাকিয়ে আছে র্সূযটার দিকে। কেনো
যেন আজ এই সূর্যটার জন্য তার মায়া লাগে। র্সূযটার মুখে এক ধরনের বেদনা আঁকা। মাঝ
আকাশে যার এতো অহংকার, ডোবার পূর্বে তার মুখে কেনো এই বেদনার ছায়া? বিষয়টা নিয়ে
মেহের মাঝে মাঝে চিন্তা করে।
এখন আষাঢ় মাস। আষাঢ় মাসে কাজে অকাজে
বৃষ্টি পড়ে। গত তিন দিন ধরে একটানা বৃষ্টির পর আজ বিকেলে জল বৃষ্টি কিছুটা বিরাম
নিয়েছিল। এখন আবার টিপটিপ ঝরতে শুরু করেছে। টিপটিপ বৃষ্টিতে একলা দাঁড়িয়ে থাকার
আনন্দ আলাদা। মেহের মহা আনন্দে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
নিচের ওই রাস্তাটায় এখন যুবক
যুবতিদের কোলাহল। রাস্তার মোড়ে বসেছে ফুচকা চটপটির পসরা। আগাম দম্পতিদের কেউ কেউ
বসেছে সেখানে। বৃষ্টি তাদের বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় নি। বরং আনন্দগুলোকে আরো বাড়িয়ে
তুলেছে। কিছু ছেলে বন্ধুর দল চটপটির দোকান পাশ কাটিয়ে হেঁটে চলেছে। যাবার সময় দলের
দু’চারটি বাঁকা চোখ আগাম দম্পতিদের দেখছে। আর দূর থেকে মেহেরের বুকের মাঝে এক ধরণের
শূণ্যতা অনুভব হচ্ছে।
একসময় সন্ধা হলে রাস্তার ল্যাম্পোষ্ট
গুলোতে আলো উঠলো। আকাশ তখনো অন্ধকারে মিলিয়ে যায় নি। সাদা মেঘলা আভা আকাশের গায়ে
তখনো মাখা। সেই মেঘলা আভায় দৃষ্টি রেখে মেহের ভাবে, জীবনটা এক অদ্ভুত ঝর্নাধারা।
যে ঝরনার উৎস কোথায়, মানুষ জানে না। অথচ সেই ঝর্না ধারা থেকে জল পান করে মানুষ
বাঁচে। ঝর্না ধারাতে মানুষের জীবন বয়ে চলে। বয়ে চলে সময় ঝরনাটার ঠিক পাশ ধরে।
মানুষ বয়ে যায় সময় ও ঝর্নার পাশ ধরে।
সন্ধা গভীর হলো। বৃষ্টি তার র্পূণ
শক্তিতে পৃথিবীতে ঝাপিয়ে পড়লো। পৃথিবীর মানুষ হলো ছন্নছাড়া। ফুচকার দোকান গোটানো হল।
ভাবী দম্পতিদের আর দেখা গেলো না। শুধু সেই ছেলে বন্ধুর দলটিকে এখনো দেখা যাচ্ছে।
রাস্তার পাশের এক ছাউনিতে সবাই জরো হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। তাদের সবার মুখ থেকে
ক্রমাগত সাদা ধোঁয়া বের হতে দেখা যাচ্ছে।
সাইনোসাইটিস জনিত ভয়ে মেহের রুমে চলে
এলো। মাকে এক কাপ চা দেবার অনুরোধ জানিয়ে সে জানালার পাশের ইজি চেয়ারে গিয়ে বসলো।
কিছুক্ষণের মাঝেই চা চলে এলো। মেহেরের সামনে চা রাখা হয়েছে। চা থেকে ধোঁয়া উঠছে।
ধোঁয়া ওঠা চায়ে সে এখন চুমুক দিবে ভাবতেই মনে ভীষণ আনন্দ হলো। চায়ে চুমুক দিয়ে
ভাবলো, মাকে ধন্যবাদ কথাটি কতো বার বলেছে সে? মেহের ইতিহাস খুঁজকে থাকলো। খোঁজা
শেষে দেখলো, ‘ধন্যবাদ’ কথাটি মাকে বলা হয় নি। মেহেরের মনে মেঘ জমলো। ইচ্ছে হলো, সে
এখন গিয়ে মাকে বলে- ‘মাগো, তুমি এতো ভালো কেনো?’ যদিও মেহের চেয়ার থেকেই উঠতে
পারলো না। কারণ, এসব কথা বলতে তার বড় লজ্জা করে। লজ্জায় চোখ মাটির দিকে নামে।
মেহের মাঝে মাঝেই চিন্তা করে, তার এতো লজ্জা কেন?
তুমুল বর্ষন শুরু হয়েছে বাইরে। অথচ
মেহের বর্ষনের সুর শুনতে পারছে না। তাদের বাড়ির ছাদ ঢালাই করা। মেহেরের প্রায়শই
ইচ্ছা হয়, সে একটি টিনের চালের বাড়ি বানাবে। ভীষণ বর্ষায় বৃষ্টির সাথে কথা বলবে।
খোলা জানালা দিয়ে বৃষ্টির ছাট
মেহেরের গায়ে এসে পরছে। পাশের টেবিলটাতে একটি কাঠ পেন্সিল পড়ে রয়েছে। বৃষ্টির ছাট
পেন্সিলের গায়ে এসে পরছে। খোলা হাওয়া ও বৃষ্টির ছাটে পেন্সিলটি নড়ে নড়ে উঠছে।
ঘটনাটি দেখে মেহের ভাবে, বৃষ্টি কি তবে মানুষের মনকে গোপনে এভাবেই নাড়া দেয়? ঠিক
এই কাঠ পেন্সিলটার মতোন?
এমনি সময়ে, ঘর অন্ধকার করে বিদ্যুত
চলে গেলো। সুসমিতা এসে একটি মোম জ্বালিয়ে চলে গেলো। সম্পর্কে সুসমিতা মেহেরের
ফুপাতো বোন। হালকা পাতলা গড়নের বড়ো সুন্দরী মেয়ে। কলেজে পড়ে। সুসমিতার বাবা চাকুরী
অব্যহতি নেবার পর সে মেহেরদের বাসায় থেকে পড়াশোনা করে ও মায়ের বিভিন্ন কাজে
সহযোগীতা করে। মায়ের ইচ্ছা, সুসমিতাকে সে তার ছেলের বউ বানায়। এই ইচ্ছায় মেহেরের
দ্বি’মত আছে কিনা, এই নিয়েও সে চিন্তা করে। মায়ের গোপন ইচ্ছাটি জানার পর থেকে
সুসমিতাকে ভীষণ ভালো লাগে। বড়ো লক্ষী মেয়ে মনে হয়।
বাতাসে মোমের আলো নিভু নিভু করছে।
একবার নিভে গিয়েও আবার জ্বলে উঠছে। মোমের আলোর সব থেকে সুন্দরতম দৃশ্য এটি। আলো
নেভার উপক্রম হলেই সমস্ত ঘর অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছে। পরক্ষণেই চারপাশ আলোয় ভরে
উঠছে। এ এক অদ্ভুত আকর্ষণের খেলা।
মেহের মোমের আগুনে তাকিয়ে আছে। তাকে
দেখে মনে হচ্ছে, সে বর্তমানে এই অদ্ভুত খেলাটির বিচারক। খেলাটিতে জাররা পরিমান
ভুলে নম্বর কাটা দেবে।
এই পর্যায়ে, দুষ্টু বৃষ্টির দমকা
হাওয়ায় মোমের আগুন নিভে গেলো। ঘর হলো অন্ধকার। মেহের পরলো বিরম্বনায়। হাতের কাছে
আলো জ্বালাবার ব্যবস্থা নেই। আলো পায় কোথায়? নানান চিন্তা ভাবনা করে বুঝতে পারলো,
আলো নিয়ে ভাবনা একটি অসীম সমূদ্র ব্যপার। মেহের থেলস্ অথবা টমাস আলফা এডিসন নয়।
তাই এ ব্যপারে ভাবনার সমাপ্তি টানতে হলো।
চারপাশে গাঢ় অন্ধকার। নিজের হাত দেখা
যায় না এমন। এ ধরনের অন্ধকারে বেশিক্ষণ থাকা যায় না। চোখ ব্যথ্যা করে। সেই কারণে,
মেহের চোখ বন্ধ করেই বসে আছে। এভাবেও বেশিক্ষণ বসে থাকা যায় না। অস্বস্তি বোধ হয়।
মেহেরের ভীষণ অস্বাস্তি বোধ হচ্ছে। অস্বস্তিতে মনে মনে বললো- কেউ কি কোথাও আছে, যে
তার ঘর আলো করতে পারে? কিছুক্ষণ পর বিজলি চমকে সমস্ত ঘর আলোয় ভরে গেলো। যদিও,
মেহেরের চোখ বন্ধ থাকায় এই আলো দেখতে পেলো না।
মেহের উদগ্রীব হয়ে বসেই আছে। কেউ
একজন এসে ঘরে আলো জ্বেলে দেবে! অথচ সময় অনেক পার হলো, এখনো কেউ আসে নি। এমনি সময়
দরজার ও’পাশ থেকে নূপূরের শব্দ কানে এলো। কেউ একজন আসছে। মন আনন্দে ভরে গেলো, ঘরে
আলো ফুটবে। মেহের কান খাড়া করলে। দরজার ও’পাশ থেকে নূপূরের শব্দ ক্রমেই কাছে আসছে।
আরো কাছে। মেহের সোজা হয়ে বসলো। বসে নিজের মনে বিড়বিড় করে বললো, আলোক দীপ্তির জন্য
আমরা এতো পাগল কেনো?
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন