খবরের পেছনে
ইশতিয়াক ফয়সল
এই বছর
শীত পড়েছে জাঁকিয়ে।
বাস
স্টপে বসে আছে সুমি।গন্তব্য বাসা। গাড়ি
নিয়ে বাবা ব্যবসার কাজে ঢাকার বাইরে, তাই আজ বাসেই ফিরতে হবে।খুব জরুরী একটা ল্যাব
ক্লাস ছিল আজ। শেষ হতে হতে সন্ধ্যা। একাই ফিরছে আজ, যদিও রাশেদ বলেছিল বাসায় পৌঁছে
দেবে। উত্তুরে হাওয়া আজ বোধহয় স্টপের দেয়ালের ভেতরে রডগুলোকেও কাঁপিয়ে দেবে। একটু
দূরেই পরিত্যক্ত ডাস্টবিনের পাশে খোলা জায়গায় আগুন জ্বালিয়ে উষ্ণ হচ্ছে ছিন্নমূল
মানুষগুলো। বেশ সচ্ছল পরিবার সুমিদের। বাবা একজন ব্যবসায়ী, কখনো
কোনঅভাবের মুখ দেখতে দেননি নিজের মেয়েকে। নিজে প্রচণ্ড কষ্ট
স্বীকার করে আজ এই পর্যায়ে এসেছেন। বাবার মুখে শোনা তাঁর অতীতের জীবন সংগ্রাম, আর
দারিদ্র্যের ভয়াল রূপ সুমিকে বুঝতে শিখিয়েছে-এই ছিন্নমূল মানুষগুলোর কি অপরিসীম
ভালবাসা জীবনের প্রতি। বেঁচে থাকার জন্যে কি সামান্য তাদের চাওয়াগুলি। মেধাবী মুখগুলো সামান্য কয়েকটা টাকার জন্যে
কিভাবে ঝরে পড়ে যায়। তার বাবা নিজেও তুখোড় মেধাবী ছাত্র হওয়া সত্ত্বেও কেবলমাত্র
অর্থাভাবে খুব ছোটবেলায় তুলে নেন সংসারের গুরুভার দায়িত্ব।
স্কুল
জীবন থেকেই বিভিন্ন সমাজসেবামূলক কাজে জড়িত সুমি। গরীব ছেলেমেয়েদের পড়ালেখার জন্যে
তারা বন্ধুরা মিলে একটা ফান্ড করেছিল। টিফিনের টাকা জমিয়ে। তারপর ওদের হাতে যখন বই খাতা আর কলম তুলে দিচ্ছিল, বুকটা ভরে উঠেছিল গভীর
আনন্দে।
এইতো
কদিন আগে খালার বাসা থেকে ফেরার সময় খালা এক রকম জোর করে ধরিয়ে দিলেন একটা
জ্যাকেট। দাদা জার্মান থেকে পাঠিয়েছেন।
বুকের কাছে একটা সুন্দর জোকার পুতুল, বাঁ পাশে ঠিক হৃদপিণ্ড বরাবর। হাতের মুঠোয় এঁটে যায়।
গাড়ি করে বাসায় ফেরার সময় সিগন্যালে দেখেছিল লোকাল বাসের এক বুড়ো কন্ট্রাক্টর দরজায় কাঁপছে শীতে।
হঠাৎ বাবার মুখের ছবিটা ভেসে উঠল মনে। বাবাও এক সময় লোকাল বাসে কন্ট্রাক্টরি
করেছেন অভাবের তাড়নায়। নিজে গাড়ি থেকে নেমে মানুষটার গায়ে জড়িয়ে দিয়েছিল জ্যাকেটটা। কি অপরিসীম কৃতজ্ঞতা ছিল মানুষটার চোখে।
“আল্লা
তোমারে অনেক বড় করুক মা জননী।”
সেই
দোয়ার উষ্ণতার কাছে এই রড কাঁপানো শীত কিছুই না।
আহ! কত স্মৃতি,
এখনও রোমন্থনে যেন মানুষগুলোর প্রার্থনার উষ্ণতা পাওয়া যায়।
এবার
শীত পড়েছে খুব জাঁকিয়ে, সেই সাথে ঘন কুয়াশা।
তারপর
কলেজে উঠে এক অসুস্থ রিক্সাওালার জন্যে সাহায্য চাইতে গিয়ে রাসেলের সাথে পরিচয়। সেদিন
ওর টেস্ট পরীক্ষা ছিল। বাসা থেকে বের হতে দেরি হয়ে গেছিল। রিকশাওয়ালাকে তাড়া দিল
“মামা
তাড়াতাড়ি টানেন। ”
কিন্তু
হাতে পড়ে যাওয়া ফোস্কার অসহ্য ব্যথায় সে কিছুতেই রিকশার হ্যান্ডেল ধরতে পারছিল না।
দূরে
থেকে একটা ছেলে লক্ষ্য করছিল একটা মেয়ে প্রচণ্ড উদ্বেগ নিয়ে রাস্তার পাশের
ফার্মেসিতে দাঁড়িয়ে একজন মানুষের হাতে ব্যান্ডেজ করা দেখছে।এইভাবে রাসেলের সাথে
প্রেম পরিণয়। রাসেল ও সুমি এখন একই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করছে। তারপর গত শীতে
উত্তাল শাহবাগ, একসাথে হাতে হাত রেখে- কেবল এই বঞ্চিত মানুষগুলির নিরাপত্তার
জন্যে।
রাসেল
ওরা গেছে ওদের ভার্সিটির চলচ্চিত্র সংসদ থেকে শীতবস্ত্র বিতরণের জন্যে উত্তরবঙ্গ। কিছু
দরকারি পরীক্ষা থাকায় সুমি যেতে পারেনি ওদের সাথে। তবে এর আগেও সে গেছে বহুবার।
এবার
শীত পড়েছে খুব জাঁকিয়ে, সেই সাথে ঘন কুয়াশা।
একটু দূরেই পরিত্যক্ত ডাস্টবিনের পাশে খোলা জায়গায় আগুন জ্বালিয়ে উষ্ণ
হচ্ছে ছিন্নমূল মানুষগুলো। বেঁচে থাকার কি
অসম লড়াই ! উষ্ণতা চাই যেকোনো মূল্যে।
বাস চলে
এসেছে, এই শীতে মানুষের আনাগোনা কম বাইরে। বাসটাও বেশ ফাঁকা। ধীর পায়ে বাসে চেপে
বসে সুমি।
পুনশ্চঃ
“রাজধানীর একটি ডোবা থেকে এক তরুণীর বিকৃত লাশ উদ্ধার। পুলিশের ধারণা ………………………”
খবরের
কাগজে একটা জিনিসের উল্লেখ আসেনি, তরুণীর ডান হাতের
মুঠোয় ধরা ছিল একটি পুতুল জোকার। খিলখিল করে তার বিরামহীন হাসি, হাসিটা কার দিকে
কারো জানা দরকার নেই। এমন কত ঘটনাই তো ঘটে আমাদের চারপাশে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন