যে চিঠি কখনো পৌঁছবে না
মিকসেতু মিঠু
শ্রদ্ধেয়
/ প্রিয় মা,
মা, বাস্তবে
তোমাকে কখনো চিঠি লিখিনি, তাই বলতে
পারছি না সম্বোধনে শ্রদ্ধেয় হবে না প্রিয় হবে? যে কোন
একটা ধরে চিঠিটা পড়ে নিও। তাতে সমস্যা হবে না। কারণ তুমি আমার সব চেয়ে প্রিয় মানুষ, আর মন
থেকে তোমার মত শ্রদ্ধা অন্য কাউকে কখনো করি নি। মা এখন তোমাকে যে কথাগুলো বলবো
সেগুলো তোমাকে অনেক আগে থেকেই বলতে চেয়েছিলাম কিন্তু পাছে তুমি কষ্ট পাও সেজন্য
বলিনি। কারণ তোমাকে আমি কখনই কষ্ট দিতে চাই নি। কিন্তু আর পারছি না। আমার বুকের
মধ্যে কথাগুলো জমতে জমতে বুকটা ফুলে ফেঁপে উঠছে। এখন যদি না
বলতে পারি তাহলে আমার বুকটা ফেটে যাবে, তাই বাধ্য
হয়ে বলতে হচ্ছে। কষ্ট পেলে ক্ষমা করে দিও প্লিজ।
মা আমাকে নিয়ে তোমার একটাই স্বপ্ন ছিল।
তোমার ছেলে ডাক্তার হবে, অনেক বড়
ডাক্তার। এজন্য তোমাকে দোষ দেই না। তোমার মত যারা মফস্বলে থাকে আর তাদের ছেলেমেয়ে
যদি পড়াশুনায় একটু ভালো হয় তখন থেকেই বাবা-মা’রা স্বপ্ন
দেখে যে তার ছেলেকে ডাক্তার বানাবে। তুমি সেই স্বপ্ন দেখে দোষ করনি। কারণ মফস্বলে
তোমার ছেলে একটু ভালো ছাত্র ছিল না। সে সবার চেয়ে ভালো ছিল। কিন্তু মা, একটা বিষয়
তুমি জানতে না, আমি জানতাম
আর সেটা হল তোমার ছেলে ডাক্তার হওয়ার জন্য জন্মে নি। তাই ডাক্তারি জিনিসটাই আমাকে
কখনো টানে নি। বায়োলজি সাবজেক্ট টা দেখলেই আমি একটু ভয় পেতাম। যাক সে কথা। তুমি
আবার ভেবো না যে তোমার চাওয়ার কোন দাম নেই আমার কাছে। এটা ভাবলে ভুল হবে। কারণ
সারা জীবন আমি তোমার চাওয়াকেই দাম দিয়ে এসেছি। মা স্কুলে আমি সবসময় ফার্স্ট হতে
চাইতাম এবং হতাম। ফার্স্ট হতে চাওয়ার পেছনে কারণ ছিলে তুমি। কারণ তোমার ছেলেকে
তুমি ফার্স্ট পজিশনে দেখতেই খুশি হতে। তোমার পরিচিত
লোকজনদের কাছে গর্ব করে বলতে আমার ছেলে বয়েজ
স্কুলের ফার্স্ট বয়, আমার ছেলে
বৃত্তি পরীক্ষায় থানার মধ্যে প্রথম। তুমি যখন অন্য কাউকে এসব বলতে তখন আমার লজ্জা
লাগতো কিন্তু তারপরেও ভালো লাগতো যে তুমি আমাকে নিয়ে গর্ব করছো। আমার অর্জন তোমাকে
খুশি করতে পেরেছে। এসব দেখে আমি তোমাকে আরও খুশি করতে চাইতাম। আরও ভালো করে পড়তাম।
যেন তোমাকে কখনো গর্ব হারাতে না হয়। আমার যুদ্ধে আমি সব সময় জিততেই চাইতাম কারণ
তোমাকে কষ্ট দেয় এমন কিছু হতে দেওয়া সম্ভব নয়। কারণ তুমি তো আমার জন্য সব সময় কষ্ট
কর এটা আমি বুঝতে পারতাম। আমার যখন জ্বর হলো, ডাক্তাররা
কেউ ধরতে পারছিলো না কিসের জ্বর তখন এই তুমিই রাত দিন এক করে মাথায় পানি ঢেলে
আমাকে সুস্থ করে তুলেছিলে। আমার বাবা ডাক্তার হয়েও যা পারেনি তা তুমি গৃহিণী হয়েই
সম্ভব করেছো! অবশ্য এতে শুধু তোমার পরিশ্রম কাজ করে নি। আমার প্রতি তোমার
ভালোবাসাও কাজ করেছে আমাকে সুস্থ করতে। বাসায় যখন ভালো রান্না হতো তুমি নিজে না
খেয়ে আমার অপেক্ষায় থেকেছো,যেন আমি
আসলে তুমি সবচেয়ে বড় মাংসের টুকরোটা আমাকে তুলে খাওয়াতে পারো। আমি মাছ খাওয়ার সময়
তুমি উদ্বিগ্ন থাকতে এই বুঝি মাছের কাঁটা তোমার ছেলের গলায় বেঁধে গেলো। আমি যে বড়
হয়ে গেছি এটা তোমার মাথায় ছিলো না।
মা আমি যখন সবচেয়ে বড় অসহায় বোধ করতাম তখন
তোমার মুখটা আমার সামনে ভেসে উঠতো, আমি আবার
সাহস ফিরে পেতাম। পরীক্ষার রেজাল্ট নিয়ে টেনশনে যখন আমার ঘুম হারাম হয়ে যেতো তখন
তুমি বলতে-যা হবার হবে। একটা কছু হলেই হল। প্রতিবার ফার্স্ট হতে হবে এমন তো কোন
কথা নেই। তোমার নির্ভার কথা আমাকে স্বাভাবিক রাখতো। আমি বুঝতাম তুমি আমাকে
স্বান্তনা দিচ্ছো তারপরেও খুশি হতাম তুমি পাশে আছো এই কথা ভেবে।
মা স্কুল কলেজে সর্বোচ্চ রেজাল্ট করে যখন
ইঞ্জিনিয়ারিং এ ভর্তি হলাম তখন তুমি একটু কষ্ট পেলেও খুশি হয়েছিলে যে, যাক তোমার
ছেলে ডাক্তার না হোক ইঞ্জিনিয়ার তো হবে। এই আশায় তুমি নিশ্চয় দিন গুনছো। কিন্তু মা
দুঃখের সাথে জানাচ্ছি যে এবারো তোমাকে হতাশ হতে হবে। কারণ তোমার ছেলে
বুঝতে পেরেছে ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার জন্যও তার জন্ম হয়নি। সে আর ইঞ্জনিয়ারিং এর এই
অসংলগ্ন জীবন টানতে পারছে না। মা তোমার ছেলের রক্তে বয়ে চলছে অন্য কিছু। যে কিছুর
সন্ধান সবাই পায় না। আমি পেয়েছি। মা লোভ-লালসা, স্বার্থপরতার
এই সাধারণ জীবন আর আমাকে টানে না। আমি জানি ভালো একটা চাকুরী করে সংসারি হয়ে নতুন
একটা বংশের সূচনা করে পৃথিবী থেকে বিদায় নেওয়ার জন্য আমি কিংবা আমরা এখানে আসি নি।
এটা সবাই বুঝতে পারে না। গড়ভরতের মত জীবন বয়ে নেওয়াকেই সবাই মনে করে এটাই জীবন।
আজীবন অর্থহীন এক মোহের পেছনে ছুটে বেরিয়ে মনে করে সে জীবন যাপন করছে। কিন্তু
ছুটতে ছুটতে ক্লান্ত হয়ে গেলে বোঝে যে এটা জীবন নয়, সে জীবন
যাপন করেনি। জীবনের নামে হয়তোবা অন্য কিছু যাপন করেছে। মা এই চিন্তাভাবনা গুলো আমি
প্রায়ই করি। শুধু চিন্তাটাই নয়। আমি অন্য কিছুর সন্ধান পেয়েছি। প্রকৃতির সন্ধান।
প্রকৃতির ডাক আমাকে সব সময় হাতছানি দিয়ে ডাকছে। স্যাররা যখন ক্লাসে পড়ায় তখনো আমি
সেই ডাক শুনতে পাই। আমার মনে হয় পুরো বোর্ড জুড়ে সবুজ শ্যামল প্রকৃতি, এখন কেবল
সেখানে হারিয়ে যাওয়ার অপেক্ষা।
মা, ভেবো না
তোমার ছেলে কোন মেয়ের প্রেমে ব্যর্থ হয়ে বৈরাগী জীবন খুঁজছে। আমি জানি আমাকে নিয়ে
তুমি এসব ভাববে না। তারপরেও তোমাকে একটা কথা বলি, এটা শুনলে
তুমি শেষ বেলায় একটু শান্তি পাবে। মা ফার্স্ট ইয়ারে একবার আমার মাথায় এই ভূত প্রথম
ভর করে। তখন আমি এটা ঠিক বুঝতে পারিনি। ভেবেছিলাম কোন মেয়ের জন্য মনে হয় আমার মন
আনচান করছে, মাথায়
গোলমাল হচ্ছে। চিকিৎসা হিসাবে সাড়ে ৩০০ কিলোমিটার দূরে এক মেয়ের সাথে দেখা করতে
ছুটেও গিয়েছিলাম। যে মেয়েটাকে আমি খুব পছন্দ করতাম। যাকে আমার অন্যান্য মেয়েদের
চেয়ে একটু বিশেষ কিছু মনে হয়েছিলো। আমি সেই মেয়েকে গিয়ে আমার সম্যার কথা খুলেও
বলেছিলাম। বলেছি আমার মাথার ব্যাথা দূর করে তুমি আমাকে ভালো করে দাও। ওই মেয়ে আমার
কথা শুনে হাঁ করে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলো। ওর বিস্ময়
মাখানো মুখের দিকে তাকিয়ে আমার একটু আফসোস
হয়েছিলো কিন্তু তাতে আমার জ্বালা দূর হয়নি। পরে সেখান থেকে আরও ২০০ কিলোমিটার দূরে
যখন তোমার কাছে ছুটে গেলাম। তখন তো এই তুমি’ই তোমার
পাগল ছেলেটাকে এক নিমিষেই সুস্থ করে তুলেছিলে। মনে আছে মা সেই রাতের কথা। রমজান
মাস ছিল। নামাজ শেষ করে তোমার তাড়াতাড়ি ঘুমানোর কথা কারণ রাতে উঠে আবার সেহরি’র জন্য
রান্না করতে হবে। মাঝরাতে হঠাৎ তোমার ঘুম ভেঙ্গে গেলো। জেগে দেখলে যে আমি তখনো
ঘুমাইনি। তুমি উদ্বিগ্ন হয়ে আমার বিছানায় এসে বসলে। তারপর জানতে চাইলে কি হয়েছে? আমি তোমার
কাছে কিছু লুকাতে পারিনি। পারবো কিভাবে, তখন যে
আমি টানা ৩/৪ রাত নির্ঘুম। না ঘুমাতে না
ঘুমাতে আর অজানা অচেনা এক ডাক শুনতে শুনতে আমি তখন পাগল প্রায়। কাঁদতে কাঁদতে তোমাকে সব
বললাম। অন্য সময় হলে তুমি হেসেই উড়িয়ে দিতে কিন্তু সে রাতে তুমি হাসো নি। আমি
দেখতে পেয়েছিলাম আমার কথা শুনে হঠাৎ তোমার মুখে অমাবশ্যার অন্ধকার নেমে এসেছিলো।
তারপর তুমি বলেছিলে যে ঘুমানোর চেষ্টা কর। ঘুমালে সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি বলেছিলাম
আমার তো কিছুতেই ঘুম আসে না। ব্যথা করে, মাথা টা
ব্যথা করে বুকের ভেতর ব্যথা করে। তখন তুমি কি করেছিলে মনে আছে তোমার মা? আমার
কিন্তু মনে আছে। আমার চোখ দুটো হাত দিয়ে বুজে দিয়ে তুমি আমার মাথা টিপে দিতে শুরু
করেছিলে। তারপর চুল গুলো ধরে একটু একটু করে টেনে দিচ্ছিলে। তখন রাত ২ টা কি ৩ টার
মত বাজে। তোমার হাতের স্পর্শে আমার ব্যথা ধীরে ধীরে কমে যেতে লাগলো। সারা শরীরে এক
অদ্ভুদ আরাম এসে ভর করেছিলো। মনে হচ্ছিলো আমার কোন কষ্ট নেই,কোন দুঃখ
নেই,কোন ব্যথা নেই। সে রাতে আমি ঘুমিয়ে
পড়েছিলাম। তুমি ঘুমিয়েছিলে কি না জানি না। কিন্তু আমি সুস্থ হয়ে গিয়েছিলাম কিছু
দিনের জন্য। কিছু দিনের জন্য বলছি কারণ সেই ব্যথাটা আবার ফিরে এসেছে মা। এখন আমি
তোমার থেকে ৫০০ কিলোমিটার দূরে। তাই তোমাকে বলছি না। কারণ জানতে পারলেই তুমি কষ্ট
পাবে। আমাকে কাছে ডাকবে। আমি সে ডাকে সাড়া না দিয়ে থাকতে পারবো না?
তুমি ভাবছো তোমাকে অবহেলা করে আমি কেন
আরেকজনার ডাকে সাড়া দিচ্ছি। কারণটা তোমাকে ভেঙ্গে বলি। মা এই ব্যথাটা আমার
চিরন্তন। তুমি হয়তোবা গতবারের মত এবারো আমাকে সুস্থ করে তুলবে। কিন্তু এভাবে কতবার? একসময়
তুমি থাকবে না, আমি থাকবো
আমার এই ব্যথাটা থাকবে, সেই
অদ্ভুদ সময়ে আমি কি করবো? না পাবো
তোমাকে না তোমার মত কোন মমতাময়ীকে। ব্যথায় আমি ছটফট করতে থাকবো আর তুমি হয়তোবা
ওপারে গিয়েও আমার ছটফটানি দেখে কষ্ট পাবে। তার চেয়ে
আমি এখনই সরে যাই সেটাই সব দিক দিয়ে ভালো। তুমি কষ্ট পাবে জানি তারপরেও তোমাকে
বলছি তোমাকে আমি অনেক অনেক অনেক ভালোবাসি মা। আমি যেখানেই যাই না কেনও, সন্যাসী
হই আর ভবঘুরেই হই না কেন তবুও আমি তোমাকে ভালবাসবো। কারণ তোমাকে ভালবাসতে না পারলে
যে আমি মরে যাবো। মা কষ্ট আমিও পাবো তারপরেও আমার একটা সুখ থাকবে যে আমি আমার
নিজের পছন্দমত জীবন বেঁচে নিতে পেরেছি। লোভ-লালসা, অর্থ
বিত্ত পায়ে ঠেলে প্রকৃতির সন্ধান করছি, জীবনের
সন্ধান করছি, ভালোবাসার
সন্ধান করছি। মা তুমি হয়তোবা আমাকে নিয়ে আর কারও কাছে গর্ব করতে পারবে না, কারণ
তোমার ছেলে ডাক্তার নয় ইঞ্জিনিয়ার নয়, তবে তুমি
এটা জেনে একটু হলেও খুশি হও যে তোমার ছেলে বোহেমিয়ান নয়, প্রথা
তাকে জড়িয়ে রাখতে পারে নি, জরা তাকে
ধরতে পারে নি, সে
দুর্বার হয়ে পুরো জীবন চষে বেড়াবে। জীবনকে সে অন্য সবার মত ভোগ করবে না, জীবনকে সে
উপভোগ করবে। সে জীবনের মানে খুঁজবে না জীবনের মানে আবিষ্কার করবে, জীবনকে জয়
করবে......।
মা, তুমি খুশি
হও প্লিজ প্লিজ......প্লিজ... প্লিজ। তুমি খুশি না হলে যে সন্যাসী হয়েও আমি ভালো
থাকতে পারবো না।
ইতি-
তোমার আদরের হতভাগা।
* * * * * *
*
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন