ছোটগল্প-শোয়েব সাইফী

অদৃশ্য অরণ্যে

শোয়েব সাইফী

  
মেহেরের হাত বেয়ে রক্ত পরছে।
অথচ সেদিকে তার খেয়াল নেই। সে জানালায় তাকিয়ে অন্ধকার আকাশ দেখছে। আকাশে তারা নেই, মেঘ আছে। চাঁদ আছে। চাঁদের সাথে মেঘের লুকোচুরি আছে। সেই লুকোচুরির কোথায় যেন মেহের তারই ছবি দেখতে পায়। মেহের তাকিয়ে থাকে। তার বড় চমৎকার মনে হয়।
চাঁদটাকে দেখলে নিজের মতো বড় একলা মনে হয়। অথচ এইতো সেদিন, চাঁদটা কতো জোছনা ছড়াতো। জোছনা রহস্য আলোয় আলোকিত হতো পৃথিবী। সেই সাথে আলোকিত হতো মেহের আর তার অবাধ্য মন। জোছনা আজ আলো ছড়ায় না। অন্ধকারে বসে থাকে মেহের। তার চারপাশে এতো আলো, অথচ এই আলো অন্ধকারের মতো মনে হয়। তবে কি এই আঁধার মৃত্যুকে আমন্ত্রণ করছে?
মাঝে মাঝে সব কিছু ভেঙে চুরমার করতে ইচ্ছা হয়। কোন অন্ধকার মাঠে গিয়ে চিৎকার করতে ইচ্ছা হয়। সে চিৎকার করতে পারে না। সে হয়তো কিছুই করতে পারে না। কেন পারে না সে? তার বাঁধা কোথায়? কেন সে মাঝে মাঝে ঘর বন্ধ করে বসে থাকে? কেন তার চোখ বেয়ে জল পড়ে? ভাবতেই মন বিদ্রহী হয়ে ওঠে। তাকে শান্ত করবার জন্য দেহের মাঝে বাস করা অচেনা মানুষটি বলে ওঠে, ‘কত ফিরে মরলিরে মন, সুখ যে তবু এলো না/ সুখের নেশায় মরলি ফিরে, সুখ মানে যে যন্ত্রণা।’
দরজায় নক করার শব্দ হলো। মেহেরের যন্ত্রণা আরো বেড়ে গেলো। ‘মেহের ভাই ভেতরে আসবো?’
মেহের কথা বললো না। তার কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। যেভাবে ছিল, সেভাবেই বসে রইলো। রইচ উদ্দিন হেলতে দুলতে ঘরে ঢুকলো। তার মুখে শরমিন্দা হাসি। হাতে চায়ের কাপ। সে চা নিয়ে এসেছে। রইচ উদ্দিন মেহেরের বাসায় রান্নাবান্নার কাজ করে। ভাত রান্না করে, তরকারি রান্না করে। রইচ উদ্দিনের ‘ভুনা মাংশ’ যে একবার খেয়েছে, তার কাছে অন্য কারো রান্না মুখে রুচবে না। রইচ উদ্দিন এসেই মেহেরের হাতের দিকে তাকালো। যদিও এতে তার কোন ভাবান্তর হলো বলে মনে হলো না। কারণ সে জানে, মেহের নামের এই মানুষটির শুধু হাত কেন, মাথা ফেটে গেলেও ফ্রাস্ট এইডের কোন ব্যবস্থাই সে নিতে চাইবে না। রইচ উদ্দিনের প্রায়শই অবাক লাগে। ভাবে, মেহের ভাইয়ের মতো মানুষেরা এমন কেন?
ছোট টেবিলটার উপর চা রাখা হয়েছে। চা থেকে ধোঁয়া উঠছে। সে ধোঁয়া নিমেষেই হারিয়ে যাচ্ছে কোথাও। মেহের তাকিয়ে আছে। তার বড় জানতে ইচ্ছে করছে, এই ধোঁয়া কোথায় গিয়ে হারিয়ে যায়? দৃশ্য কোথায় গিয়ে অদৃশ্য হয়ে যায়।
‘কাটা হাত নিয়ে এভাবে বসে আছো কেন মেহের?’
মেহের পাশে তাকালো। তার বন্ধু এসেছে। যদিও মেহের তার এই বন্ধুটিকে দেখতে পায় না। তার এই বন্ধুটি অদৃশ্যে থাকে। অদৃশ্য বন্ধু অদৃশ্যে থাকতে পছন্দ করে। এ কারণে মেহের তাকে দৃশ্যে আনবার চেষ্টা করে না। নিঃসঙ্গ মানুষের সব সময়ই একজন অদৃশ্য বন্ধু থাকে। যে তার নিঃসঙ্গতা দূর করে। মন খারাপ হলে উল্লাসের গল্প বলে। বহুসঙ্গ মানুষেরা এই বন্ধুটির উপস্থিতি ধরতে পারে না। মেহের তার এই বন্ধুর নাম দিয়েছে, ‘নিস্তব্ধতা’। নিস্তব্ধতা পাশের চেয়ারটাতে বসে আছে। তার দৃষ্টি আকাশের দিকে। অন্ধকারের ‘মেঘ লুকোচুরি’ আকাশ দেখছে। কী জানি, সেও হয়তো মেহেরের মতোই চিন্তা ভাবনা করছে!
মেহেরের ঠোঁটে হাসি দেখা গেলো। বললো, ‘আকাশের দিকে তাকিয়ে কি দেখো গো?’
‘অন্ধকার দেখি। নিকষ অন্ধকারে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায় না। ঠিক তেমনি, খুব শুভ্রতার মাঝে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকলে চোখে ঘোলা ধরে। খুব ঘন কুয়াশার মাঝে যদি কখনো যাও দেখতে পাবে। যেখানে নিজেকে ছাড়া আর কিছুই দেখা যায় না। চারপাশ সাদা আর সাদা। অস্বস্তিকর শুভ্রতা। বেশিক্ষণ তাকালে মনে হবে মড়ে গিয়েছি। এ আলাদা কোন জগৎ সংসার।’
মেহের কি বলবে বুঝতে পারছে না। নিস্তব্ধতা নামের এই বন্ধুটি প্রায়শই অসাধারণ কিছু কথা বলে। যদিও এসব কথা শুনতে অন্যদের পাগলামো মনে হয়। যে কারণে, মেহেরের মাঝে মাঝে পাগলামোর মানদন্ড জানতে ইচ্ছা করে। মানদন্ড কে ঠিক করবে তাও জানতে ইচ্ছা করে। পৃথিবীর কতো অসাধারণ মানুষেরা গাছের সাথে কথা বলেছে। অথচ সবাই কি গাছের কথা শুনতে পেয়েছে?
ঘড়ির দিকে তাকাতেই মেহেরের অস্থিরতা প্রকাশ পেলো। অস্থিরতায় পা’দুটো কলের মেশিনের মতো নড়তে শুরু করলো। অস্থিরতার বিষয়, মেহেরকে এখন উঠতে হবে। এখন সে এক নিভৃত জায়গায় যাবে। নিভৃত জায়গাটাতে মেহের একটি বিশেষ দিনে যায়। একাই যায়। যদিও, এই ‘নিভৃত যাত্রার’ কারণ কেউ জানে না। আজ সেই বিশেষ দিন। মেহের তড়িঘড়ি করে রুম থেকে বেরিয়ে পরলো। রাস্তায় উঠতেই রিক্সা পেলো। আবছা আলোর ভেতর দিয়ে রিক্সা চলতে শুরু করলো। সেই আবছা আলোতে মেহের দেখলো, হাতের ক্ষত স্থানটাতে রক্ত জমাট বাঁধতে শুরু করেছে।
চার লেনের বিশাল রাস্তাটার পাশে রিক্সা এসে থামলো। মেহের উঁচু ফুটওয়াকের একপাশে গিয়ে বসলো। জায়গাটা ভিষন নিভৃত হলেও অসাধারণ। সোডিয়াম লাইটের আলোতে চারপাশ ঝকমক করছে। ঝকমকে এই আলোতে মেহেরের গায়ের রং পাল্টেছে, শার্টের রং বদলেছে। মধ্যে রাতের পাগলপারা ফাল্গুনী হাওয়া বয়ে চলেছে। সেই হাওয়া থেকে মিষ্টি গন্ধ মেহেরের নাকে এসে লাগছে।
মেহের ঘড়ির দিকে তাকালো। রাত ১২:৩৬ মিনিট। সময় দেখে কিছুটা চমকে উঠলো। কপালে ভাঁজ পড়লো। মেহেরের একবার মনে হলো, বাসায় চলে যায়। কিন্তু সে যেতে পারলো না। কোন এক মহাশক্তি তাকে বসিয়ে রাখলো। মহাশক্তি তাকে চুপি চুপি বললো, ‘বসে থাকো। কেন অর্ধৈয হচ্ছো? সে আসবে। সে অবশ্যাই আসবে। সে আজ ‘লাল পেড়ে’ শাড়ি পড়ে আসবে। তার কপালে থাকবে লাল রঙা টিপ। পূর্ণীমার মায়াবী আলোয় তাকে দেখতে লাগবে কল্পিত কিন্নরী। ফাল্গুনী বাতাস বয়ে যাবে। সে বাতাসে হারিয়ে যাবে দু’জন। তার নূপূরের শব্দে হবে পাগলপারা। কেন অর্ধৈয হও? সেতো আজ তোমারি কাছে আসবে!’
মেহের কি করবে বুঝতে পারছে না। সে মহাশক্তির কথা উপেক্ষা করতে পারে না। তার সে ক্ষমতা নেই। মেহের মাঝে মাঝে চিন্তা করে, নিজের শরীর কেটে দু’টুকরো করা সম্ভব। অদৃশ্য ক্ষমতার প্রলভন ভুলে থাকা প্রায়শই সম্ভব হয় না। কিন্তু মেহের তো এসকল চিরাচরিত ধারা থেকে বেরিয়ে আসতে চায়! মানুষের কামনা বাসনা থেকে মুক্ত হতে চায়। মানুষ হয়েও মানুষের সত্তা থেকে বেরিয়ে আসতে চায়। সে বেরিয়ে আসতে পারে না। তার শত চেষ্টা বৃথা যায়। পরাজিতের কষ্ট হয়। বুকে চাপা কষ্টের চিৎকার চেপে থাকে। চোখ বেয়ে অদৃশ্য রক্ত মাটিতে ঝরে পড়ে। মেহের মাটিতে তাকিয়ে থাকে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন