ছোটগল্প-মিকসেতু মিঠু

কালো হিমু এবং...

মিকসেতু মিঠু


এক.
রাস্তায় হাঁটার সময় টাকা পয়সা নিয়ে চিন্তাভাবনা করা মহাপুরুষের কাজ না। তাদের নিজেদের প্রয়োজনে কখনও টাকা লাগে না। তাই চিন্তাও করতে হয় না। কিন্তু এই ব্যতিক্রমী ঘটনা হিমুর জীবনে ঘটছে। এই মুহূর্তে হিমুকে টাকার সন্ধানে রাস্তায় হাঁটতে হচ্ছে। অন্যের জন্য না, নিজের প্রয়জনেই ওর হাজার তিনেক টাকা প্রয়োজন। টাকার জন্য রাস্তায় ঘোরার পরেও হিমুর ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না ওর মত মহাপুরুষ পর্যায়ের একজন টাকার মত তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে দুশ্চিন্তা করছে। যদিও ও জানে যেভাবেই হোক বিকালের আগেই ওর টাকা ম্যানেজ হয়ে যাবে তারপরেও মাথা থেকে ভাবনাটা বাদ দিতে পারছে না। আজ একটা গুরুত্বপূর্ণ দিন। শুধু টাকা ম্যানেজ হলেই হবে না। তারপরেও অনেকগুলো কাজ বাকী।
কাজের কথা ভাবতে ভাবতে হিমু হাঁটছিলো মৌচাক মার্কেটের পাশ দিয়ে আসার সময় “এই হিমু,এই...” ডাক শুনে থমকে দাঁড়াতে হলো। মাথা তুলে দেখলো একটা সাদা গাড়ির ভেতর থেকে ওর মাজেদা খালা হাত উঁচিয়ে ওকে ডাকছেন। খালাকে দেখেই হিমু বুঝলো ঘটনা ঘটে গেছে। দুশ্চিন্তার ইতি। খালার কাছে গিয়ে বললো-‘কি খবর খালা,তুমি এই গরমে এখানে কি করছো?’
-আর বলিস না। একটা কাজ আছে। তুই একটু সাহায্য করতে পারবি?
-কি করতে হবে বল?
খালার কথার সারমর্ম হলো-“এক লোক নাকি ঝুড়িতে করে কচ্ছপের ডিম বিক্রি করছে। সাধারণ কচ্ছপের ডিম না,লাল রঙের ডিম। এই দিমের গুণ হলো ডিম ভেঙ্গে গায়ে মাখলে নাকি ঝট করে ২০ বছর বয়স কমে যায়। এটা শোনার পর খালা ডিম কেনার জন্য গাড়িতে বসে আছেন। ডিমওয়ালা মৌচাক মার্কেটের ভেতরে ঢুকেছে আর বের হচ্ছে না।”
অন্য সময় হলে খালার সঙ্গে এই ব্যাপারে দীর্ঘক্ষণ কথা বলতো। এই ফালতু ডিম চিন্তা করতে হয়তোবা নিষেধ করতো। কিন্তু এখন অবস্থা ভিন্ন। হিমু টোপ ফেললো।
-তুমি চাচ্ছো, আমি গিয়ে ডিমওয়ালাকে ম্যানেজ করে ডিম নিয়ে আসি।
-হু, তাই কর। এই ভিড়ে আমি ঢুকতে পারবো না। এই নে টাকা। একটু তাড়াতাড়ি কর, শেষ হলে আজীবন আফসোস থেকে যাবে রে। শুনলাম খুব নাকি কাড়াকাড়ি পড়ে গেছে।
-হালি কত টাকা করে?
-কি বলিস,হালি! একটা ডিম পেলেই জন্ম সার্থক। পাঁচ হাজার টাকা নিয়ে যা। একটু মুলামুলি করিস, তবে পাঁচ হাজার লাস্ট দাম। আর একটা পয়সাও নেই আমার কাছে।
মাজেদা খালার কাছ থেকে পাঁচ হাজার টাকা নিয়ে হিমু মার্কেটের ভেতর ঢুকলো। ওর টাকার সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে। কচ্ছপের ডিমওয়ালাকে খুঁজে সময় নষ্ট করার কোন মানে হয় না। একটা ষ্টেশনারী থেকে বিদেশী মুরগির একটা ডিম কিনে কিছুক্ষণ অযথা সময় কাটিয়ে মাজেদা খালার কাছে ফিরে এলো। খালা ওকে দেখে উদ্বিগ্ন মুখে জিজ্ঞেস করলেন-“পেয়েছিস?”
-কি যে বল না খালা। আমি না পেলে কে পাবে? আমি হচ্ছি গিয়ে দ্যা গ্রেট হিমু।’ বলে হাতে ধরা ডিমটা এগিয়ে দিলো। খালা কিছুক্ষণ সন্দেহের চোখে নাড়াচাড়া করে বললেন-“কি রে মুরগির ডিম টিম নয়তো আবার? দেশে তো লোক ঠকানো ব্যবসার অভাব নেই।”
-না খালা, আমি নিজে দেখেশুনে যাচাই করে কিনেছি। রঙটা একটু চটে গেছে,তাই খয়েরী লাগছে। চিন্তার কিছু নেই, বাসায় গিয়ে পরীক্ষা করিও।
-কতো নিলো রে?
-‘পাঁচ হাজারের নিচে তো নামবে না,অনেকক্ষণ মুলোমুলি করে চারে রাজী করালাম। এই নাও এক হাজার টাকা।’হিমু এক হাজার টাকা বাড়িয়ে ধরলো।
-থাক, টাকা ফেরত দিতে হবে না। তুই রেখে দে। আর আমার সাথে চল না হয়,ডিমের গুনাগুণ নিজের চোখে দেখবি?
-এখন না খালা, একটু কাজ আছে। কাল যাবো।
-ঠিক আছে, আমি যাই রে। আমার বেশিক্ষন দেরী সহ্য হচ্ছে না।
খালার গাড়ি চলে যাবার পর হিমু বাকী টাকাটাও বের করলো। হাতে পাঁচ হাজার টাকা নিয়ে আবারো মৌচাক মার্কেটে ঢুকে পড়লো। কচ্ছপের ডিম কেনার জন্য নয়,অন্য কারণে।
দুই.
-হ্যালো, রূপা আমি হিমু।
-তুমি যে হিমু এটা কি বলতে হবে? আমি কি তোমার গলার স্বর চিনতে পারবো না?
-না, সেজন্য নয়। মানুষ জাতির সবাই নিজের পরিচয় দিতে ভালোবাসে তো তাই দিলাম আর কি।
-তা-ই? তা তুমি তো মানুষ জাতির পর্যায়ে পড়ো না।
-আমি কিসের পর্যায়ে পড়ি,পশু শ্রেণীর?
-না, না...তা হবে কেনও? তুমি তো সাধারণ কেউ নও,তুমি হচ্ছো মহাপুরুষ, তুমি...
-তুমি কি আমার সাথে ঝগড়া করবে?
-না ঝগড়া করবো না। ঝগড়া তার সাথেই করা যায়-যে ঝগড়ার মানে বোঝে। বলো, ফোন করেছো কেনো?
-একটু মৌচাক মার্কেটে আসতে পারবে?
-কবে?
-আজ,এখন।
-গেলে কি তোমার দেখা পাবো? নাকি আমাকে ডেকে পালিয়ে যাবে আগের মত?
-এসেই দেখো না। আমি অপেক্ষা করছি।
হিমু ফোন রেখে ওভার ব্রিজের উপর দাঁড়িয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। হাতে দুটো প্যাকেট। রূপা এলো ৪০ মিনিট পর। এসেই বললো-ধন্যবাদ।
-ধন্যবাদ তো আমি তোমাকে দেব,তুমি দিচ্ছ কেনও?
-কতোদিন পর তোমার সাথে দেখা হলো জানো?৩৬৫ দিন পর। সেই যে গত বছর শহীদ মিনারে দেখা হয়েছিলো তারপর আজ।
-স্মৃতি রোমন্থন থাক না রূপা। এমনিতেই বলো তুমি কেমন আছো?
-এই মুহূর্তে আমি এতো ভালো আছি যা কখনও থাকা সম্ভব নয়।
রূপার কথা শুনে হিমু একটু হাসলো। বললো-“আমাকে জিজ্ঞেস করলে না আমি কেমন আছি?”
-তুমি কেমন আছো?
-আমি ভালো নেই রূপা। গত এক বছর থেকেই আমি ভালো নেই। আমি আর আগের মত জ্যোৎস্না দেখতে পারি না,বৃষ্টিতে ভিজতে পারি না,রাস্তায় হাঁটতেও ভালো লাগে না। রূপা বলো তো কেন এমন হচ্ছে?
রূপা হিমুর একটা হাত ওর হাতে তুলে নিলো। চোখের দিকে তাকিয়ে বললো-“তোমার কিছু হয় নি হিমু। গত এক বছর ধরে শুধু তুমি নও, আমরা কেউ’ই তো ভালো নেই।”
এরপর কিছুক্ষণ নীরবতা। তারপর রূপা’ই বললো-“হিমু তোমার সাথে জ্যোৎস্না দেখতে যাবো।”
-সত্যি যাবে রূপা?
-হ্যাঁ, যাবো। কবে যেতে চাও বলো?
-আজ’ই চলো।
-আজকেই?
-হু।
-ঠিক আছে।
-আর এই প্যাকেটটা রাখো?
হিমু রূপার হাতে একটা প্যাকেট ধরিয়ে দিলো। রূপা প্যাকেট খুলে দেখে একটা শাড়ি। কালো রঙের পিওর সিল্ক। কালোর মাঝে রুপোর চুমকি দিয়ে বড় বড় ফুলের কাজ করা আছে। রূপা আনন্দ চেপে রাখতে না পেরে বললো-‘আমার জন্য?’
-হু,তোমাকে তো কখনও কিছু দেয়া হয় না। সবসময় ঋণী থেকে যাই,তাই আজ একটু দেয়ার চেষ্টা করলাম।
-ধন্যবাদ। তোমার হাতে কি? হিমু ওর হাতের প্যাকেট টা খুলে দেখালো। একটা পাঞ্জাবী। এটাও কালো রঙের। রূপা কিছুটা বিস্মিত হয়ে বললো-“কালো পাঞ্জাবী,কালো কাপড় কি জন্য?”
-এগুলো পড়ে জ্যোৎস্না দেখতে যাবো।
-কালো রঙ পড়ে কেউ জ্যোৎস্না দেখে?
-আজ আমরা দেখবো।
-তুমি সব সময় উদ্ভট উদ্ভট কাজ কেনও করো, বলো তো?
-রূপা আজকের তারিখটা তোমার মনে আছে?
-থাকবে না কেনো?
-বলো তো?
-১৯ জুলাই।
-বিকাল ৫ টায় শালবনে জ্যোৎস্না দেখার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হবো,তৈরি থেকো। আর কিছু বলার প্রয়োজন আছে?
রূপা এতক্ষনে কালো রঙের কারণ বুঝতে পারলো। এটা বুঝতে পেরে না-সূচক মাথা নাড়লো-আর কিছু বলার প্রয়োজন নেই।
তিন.
রূপা আর হিমু যখন পাবলিক বাসে করে গাজীপুর পৌঁছলো তখন রাত ৯ টা বেজে গেছে। বিকাল ৫ টার দিকে ওরা বনানী থেকে রওয়ানা হয়েছিলো। রাস্তায় এতো জ্যাম,আসতে ৪ ঘণ্টা লাগলো। রূপা গাড়ি নিয়ে আসতে চেয়েছিলো,হিমু নিষেধ করেছে। হিমুর পড়নে কালো রঙের পাঞ্জাবী,রূপার পরনে হিমুর দেওয়া কালো শাড়ি। এছাড়াও হিমুর হাতে ব্যাগ ভর্তি কদম ফুল, আর রূপার হাতে এক গাদা বেলি ফুল। ওরা যখন গাজীপুর চৌরাস্তার মোড়ে নামলো তখন টিপ টিপ করে বৃষ্টি পড়া শুরু হয়েছে। বাধ্য হয়ে সি এন জি ঠিক করে উঠে পড়লো।
সি এন জি যখন ‘নুহাশ পল্লীর’ গেটে এসে থামলো তখন রাত ১১ টা ১৫। ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে ওরা দু’জন ভেতরে ঢুকে পড়লো। বৃষ্টি ততক্ষণে একেবারেই থেমে গেছে। গেট দিয়ে ঢুকে ওরা সরাসরি হাঁটতে লাগলো। কিছুদূর এগিয়ে হাতের বাম দিকে লিচু বাগানের কাছে এলো। এখানে লিচু গাছের নিচে ফুলে ফুলে ভরে ওঠা একটা কবরের কাছে এসে থমকে দাঁড়ালো। দু’জন চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে কদম আর বেলি ফুলগুলো কবরের উপর রাখলো। চলে আসার আগে হিমু বিড়বিড় করে বলতে লাগলো-‘হে মহান স্রষ্টা,আপনি আমার ভালোবাসা এবং শ্রদ্ধা গ্রহণ করুন। আপনাকে ছাড়া আমরা অসহায়। জানিনা ওপাড়ের পৃথিবীটা কেমন? তারপরেও কামনা করি মহা শক্তিধর বলে যে’ই থাকুক না কেনো তিনি আপনাকে ভালো রাখুন, আনন্দে রাখুন ঠিক আপনি যতোটা আনন্দে রেখেছিলেন অজস্র পাঠককে।’ বলতে বলতে হিমুর গলা ধরে এলো।
চার.
ফিরবার পথে গেটে এসে হিমু লক্ষ্য করলো ওদের সাথে গেটে আরও দুজন দাঁড়িয়ে আছেন। মিসির আলী আর শুভ্র। ওদের দিকে তাকাতেই শুভ্র বললো-“আপনাদের জন্য অপেক্ষা করছি,চলুন যাই,রাত অনেক হয়েছে।”
গাড়িতে উঠতে উঠতে মিসির আলী বললেন-‘বুঝলেন, হিমু সাহেব, শরীরটা খুব খারাপ,তারপরেও আসতে হলো। মনটাও ভীষণ খারাপ ছিলো,সবাইকে দেখে এখন একটু ভালো লাগছে।’ হিমু কিছু বললো না। ড্রাইভার গাড়ি ছেড়ে দিলো।
শালবনের ভেতর দিয়ে গাড়ি চলছিলো। হিমু বললো-‘কিছু মনে করবেন না। আমরা এখানে নেমে যাবো।’ ড্রাইভার গাড়ি থামালো। মিসির আলী কিছু বললেন না। হিমুর মনে হলো ভদ্রলোক ইদানীং যেন আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন। শুভ্র বললো-‘আপনারা কি রাত জেগে জ্যোৎস্না দেখবেন?”
হিমু বললো-‘হ্যাঁ।’
-যদি কিছু মনে না করেন,আমি কি আপনাদের সাথে থাকতে পারি?
হিমু রূপার মুখের দিকে তাকালো। রূপা রাজী। দুজনে মিলে দেখাও যা,তিন জন মিলে দেখাও তা। হিমুর হঠাৎ মনে হলো-জ্যোৎস্না একা দেখার চেয়ে সবার সাথে দেখাই ভালো। এ কয়েকদিনে ও বুঝতে পেরেছে জ্যোৎস্না একা দেখলে মন খারাপ হয়ে যায়। আর তাছাড়া শুভ্র নামের চশমা পড়া ছেলেটা ওদের সাথে থাকতে চাচ্ছে,থাকুক না। অসুবিধা কি? হিমুর মনে হলো-প্রকৃতি’ই এই ব্যবস্থা করেছে। কারণ প্রকৃতি বিজোড় সংখ্যা পছন্দ করে শুভ্র খুশি হয়ে ড্রাইভারকে চলে যেতে বললো। মিসির আলী খক খক করে কিছুক্ষণ কাশলেন। বললেন-‘শরীরটা বিশেষ ভালো নেই,থাকলে আমিও আপনাদের সাথে থেকে যেতাম। আমি দুঃখিত।’
হিমু বললো-‘আপনার দুঃখিত হওয়ার কিছু নেই। আপনি সুস্থ থাকুন এই কামনা করি
গাড়ি মিসির আলী কে নিয়ে চলে গেলো। হিমু,রূপা আর শুভ্র জঙ্গলের গভীরে ঢুকে যেতে লাগলো। রাত একটার মত বাজে। সন্ধ্যাবেলা বৃষ্টি হওয়ায় আকাশ এখন অনেক পরিষ্কার জ্যোৎস্নার রূপোলী আলোয় চারদিক উদ্ভাসিত হয়ে আছে। হাঁটতে হাঁটতে হিমুর মনে হলো-জ্যোৎস্নার স্পর্শে বনের গাছপালাগুলো যেনও জেগে উঠেছে। ইস্‌। জ্যোৎস্নার স্পর্শে যদি মৃত মানুষেরাও জেগে উঠতো! হিমু দীর্ঘশ্বাস চাপলো।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন