ভালবাসার পূর্ণতা
ইবরার আমিন সালমান
রাত দশটা. রেহানা বেগম শুয়ে আছেন, ঘুম আসবে তাই বলে নয়. কখনো এপাশ কখনো ওপাশ করে কাটছে সময়. অনেক টা নিশ্চুপ হয়ে তিনি কাঁদছেন. অঝোর ধারায় তার চোখ থেকে বৃষ্টি না পড়লে ও মনের ভিতর ঠিক ই বন্যা হয়ে যাচ্ছে. কখন যে কয়েক ফোটা বৃষ্টি তার নাক ছুঁয়ে দিলো তিনি বুঝতেই পারলেন না. কখনো আগে এমন হয়নি তার,
তবে আজ অনেক কষ্ট হচ্ছে তার. তিনি খুব নরম মনের মানুষ, কখনো কাউকে বকা দিতে পারেন না. হাসিমাখা মুখ নিয়ে একমাত্র মেয়ের সাথে খুনসুটি করতে থাকেন. তার একমাত্র মেয়ে অহনা. তার দুচোখের অশ্রু হোক আর সুখ হোক সব টা ই এই অহনা..
কিন্তু আজ সন্ধ্যায় হঠাত্ করে তা পাল্টে গেল!
মাগরিবের নামাজ শেষে রেহানা বেগম তার মেয়ের রুমে গেলেন, গিয়ে মেয়ের পাশে বসলেন. মামনি সামনে তোমার পরীক্ষা এখন এই কয়দিন একটু পড়ো, মেয়ে কিছু না বলে অহনা সে তার কাজে মগ্ন. অহনার কাজ একটাই, পড়া বাদ দিয়ে পিসিতে গেমস খেলা. মেয়েকে বলে যাচ্ছেন রেহানা বেগম কিন্তু সেদিকে অহনার কর্ণপাত ই নেই! মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে রেহানা বেগম বললেন, মামনি এখন খেলা রাখো পরে খেলতে পারবে. পড়তো বসো মামনি. আমার পড়তে ভালো লাগছেনা এখন তুমি যাও এখন এখান থেকে. মামনি একটু পড়ো! না আমি পড়বো না. রেহানা বেগম কেন যেন আজ একটু রাগের স্বরে বলেই ফেললেন, পড়বিনা কেন? পড়তে অসুবিধে কোথায়? আর গেমস খেলা বন্ধ, আর কখনো খেলবিনা এটা. মায়ের এমন কথায় অহনা ও মেজাজ গরম করে বলে দিলো যদি খেলি তবে কি করবে তুমি? রেহানা বেগম কিছু না ভেবে অহনার গালে থাপ্পড় দিয়ে চলে গেল..
অহনা বুঝতেই পারেনি তার মা তাকে আজ মেরেছে! যে মা তাকে কখনো মারবে কি একটু বকা দেয়নি, সে মা আজ তাকে মারলো? অহনার অভিমান টা ও আজ বেড়ে গেলো, তাই অহনা তার রুমের লাইট অফ করে শুয়ে পড়লো. অহনা শুয়ে আছে. সব ভাবনা তার নিজেকে নিয়ে এখন, কেন যে মাকে কষ্ট দিতে গেলাম? মা তো আমাকে খারাপ কিছু বলেনি! পড়তে বেলেছেন শুধু. সামনে আমার এস এস সি পরীক্ষা, দুইমাস বাকি. মা কে কিভাবে বুঝাই আমার পড়তে ভালো লাগেনা..
রেহানা বেগম তার রুমে এসে বসে আছে, কখনো তিনি মেয়ে মারেননি, আজ তিনি তার মেয়েকে আঘাত করেছেন? ভাবতেই খুব কষ্ট হচ্ছে তার. যেদিন অহনার বাবা এ দুনিয়া ছেড়ে চলে যান, সেদিন অহনা ছিল ছোট্ট শিশু. সেদিন তিনি তার মেয়ের সামনে কাঁদেননি. তার মেয়ের সামনে চোখের অশ্রু ফেলে তার মেয়ের অবুঝ বুঝ কে শিখাতে চান নি. মায়ের চোখের অশ্রু ও ছোট্ট শিশু বুঝতে পারে, মায়ের কান্নায় ও শিশুরা কেঁদে ফেলে. সেই থেকে আজ পর্যন্ত তার মেয়ের সামনে মন ও খারাপ করেননি. এখন তার ছোট্ট পরিবার তিনি আর অহনা. অহনা ই তার সুখ.
স্বামীর রেখে যাওয়া তিন তালার একটা ছোট বাড়ী.. নিজের একমাত্র মেয়েকে নিয়েই আছেন বেশ এখানে..
রাত নয়টা, অহনার মন আরো খারাপ হচ্ছে, এখন তার মায়ের কাছে যেতে ইচ্ছে করছে. মাকে কষ্ট দিয়েছে সে কারনেও মায়ের কাছে যেতে পারছেনা. অন্ধকারে ই শুয়ে আছে অহনা.. মাকে গিয়ে তার বলতে ইচ্ছে করছে মা অনেক ভূল করে ফেলেছি আমি, আমায় অনেক ক্ষমা করে দাও. আমাকে তোমার কোলে রেখে ঘুম পাড়িয়ে দাও, আমাকে আদর করে দাও. তোমার দুষ্ট ছোট্ট মেয়ে বলে ডাক দাও! রেহানা বেগম প্রতিদিন তার মেয়েকে তার কোলে রেখে ঘুম পাড়ায়, প্রতিদিন তাকে আদর করে, দুষ্টামি করে. মাঝে মাঝে মেয়ের ঘুমের চেহারা দেখে হাসেন, তার মেয়ের চেহারায় তার যে সুখ তা তিনি অনুভব করেন তার কোলে মেয়েকে রেখে. কখনো কখনো নাক টা টিপে দেন পিচ্চি মেয়েটার..
রাত দশটা. রেহানা বেগম কিছুতেই বুঝাতে পারছেন না নিজেকে, তাই অনেক কাঁদছেন তিনি. তিনি আজ তার নিজেকেই মেরেছেন, মেয়েকে কষ্ট দিয়ে তিনি ই তো সে কষ্ট পাচ্ছেন.. হঠাত্ একটি হাতের ছোঁয়া তার মাথায় পড়লো, তার কান্না তখন ই থেমে গেলো. মা, মাগো,, তোমার মিষ্টি হাতের ছোঁয়ায় আমায় আরেক টু মারবে? তোমার শাসন টা ও যে বড় মধুর. এতোদিন আমি এক সুখে ছিলাম, আজ আমি তোমার দুই সুখ পেলাম মা. তোমার আরো কিছু সুখ আমায় দাওনা মা! প্লিজ দাওনা মা!
রেহানা বেগম তার পিচ্চি মেয়েকে তার বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরলেন. তিনি এখন কাঁদছে পারছেন না, এই মেয়ের সামনে তার যে কান্না আসেনা...
মামনি আমার সব সুখের ছোঁয়া তুমি. তোমাকে ছাড়া আমি সুখ খুঁজে পাইনা... আজ মা মেয়ে কাঁদছে, তবে মায়ের কান্না মেয়েকে বুঝতে দেয়না, আর মেয়ের কান্না মা বুঝে নেয়.. এটাই যে তাদের ভালবাসার পূর্ণতা, তাদের আনন্দ. আজ তাদের অশ্রুরাই বলছে, আমরা তোমাদের এমন সুখের অশ্রু হতে চাই আরো বেশি হতে চাই. আমরা তোমাদের সুখেই সুখী।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন