আনজানা
সন্দীপ দাস
৷১৷
কলকাতায়
এবার শীতটা বিগত কয়েক বছরের মত অতটা জাঁকিয়ে পরেনি,তবে তাই বলে সৌখিন বাঙালির সকাল
কি আর চা এর কাপ এ ঝড় না তুলে ভাঙতে পারে।আর আমি সেই গতে বাঁধা ছকের একচুল ও বাইরে
পরিনা,অর্থাৎ ভোর হতে না হতেই গন্তব্য কল্যানদার চায়ের দোকান।By the
way,আমার পরিচয়টা দেওয়া হয়নি,আমি তৃণাভ ঘশ,বয়স ছাব্বিশ,পেশায়ে দচতর,আরো বিষদে বললে
Dentist,তবে ডাক্তারিতে আমার মন নেই,ছোটোবেলা থেকেই সঙ্গীতের উপর
আমার একটা অমোঘ আকর্ষণ ছিল,ইদানিংসেটা নিয়েই বেশি ব্যস্ত রয়েছি।য়ামি আর আমার জনা
চারেক বন্ধু মিলে একটা বাংলা ফিউশন ব্যান্ড খুলেছি,বেশ কিছু শো করাও হয়ে গেল,সত্যি
কথা বলতে গেলে পাবলিক এর রিঅ্যাকশন অত্যন্ত আশাপ্রদ।
কল্যানদার
চায়ের দোকানটা আহিরীটোলা কালি মন্দির এর ঠিক পাশে,আমার বারি বেনিয়াটোলা লোনে,বাড়ি
থেকে বেড়িয়ে মর্নিং ওয়াক করে সোজা কল্যানদার দোকানে চলে আসি।আমার বাকি বন্ধুগুলো
থাকে দক্ষিণ কলকাতায়,তাই এই তল্লাটে আমার সঙ্গ দেওয়ার কেউ নেই।আজ ও আমি মর্নিং
ওয়াক সেরে কল্যানদার দোকানে এসে সবে বসেছি আর ইদানিং জনপ্রিয় হয়ে ওঠা একটা
সংবাদপত্রের হেডলাইনগুলোর দিকে মনোনিবেশ করার চেষ্টা করছি,ঠিক সেই সময় আমার নজর
গিয়ে পরল মাঝরাস্তায়ে দাঁড়িয়ে থাকা একটা মেয়ের দিকে।মেয়েটাকে দেখে যথেষ্ঠ
সমভ্রান্ত ঘরের বলেই মনে হয় কিন্তু মাঝরাস্তায়ে দাঁড়িয়ে সে যে কী করার কথা ভাবছে
সেটা আমার মাথায় ঢুকলনণাআজ কুয়াশাটা অন্যান্য দিনের তুলনায় একটু বেশী,তাই রাস্তায়
গাড়ি-ঘোড়ার সংখ্যাটা বেশ কম।তবু কেন জানিনা মেয়েটার গতিবিধি আমার ভালো
ঠেকলনা,প্রায় মিনিটতিনেক ধরে সে ঐ একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে,কি জানি কি ভাবছে, ভীষণ
অন্যমনস্ক দেখাচ্ছে তাকে।ইতিমধ্যে আমার নজর পরল ২১১এ নাকি ২১৫এ বাসটার দিকে,বেশ
জোর গতিতে ছুটে আসছে,এক মুহূর্তের জন্যে আমার মনে হল মেয়েটা আলবাত সুইসাইড করতে চলেছে।কোনও
কিছু বুঝে উঠবার আগেই আমি দৌড়াতে শুরু করেছি, কোন এক আজানা শক্তি আমায় যেন চালিত
করছে মেয়েটার দিকে – আমাকে অকে বাঁচাতেই হবে।
“সাইডে
সরে গিয়ে ভাবনাচিন্তা করুন,প্লিজ ক্রস দ্য রোড।” আমি চিৎকার করতে করতে দৌড়ে
ছলেছি,আমার শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে,বাস এর শব্দ আরো প্রবলভাবে আমার কানে বাজছে।----
হঠাৎ
মেয়েটার সম্বিত ফিরল-একবার আমার দিকে আর একবার বাসটার দিকে ফিরে দেখল,তারপর একছুটে
সোজা আমার বুকের ভিতর,মানে আমায় জড়িয়ে ধরল।
বাসটা
আমাদের পাশদিয়ে প্রবলগতিতে চলে গেল আর ক্ষনিকের হকচকানি কাটিয়ে আমি মেয়েটার থেকে
নিজেকে আলিঙ্গন্মুক্ত করে বললাম,“কোন সমস্যায় পরেছেন কি?আমি কি কোনভাবে সাহায্য
করতে পারি?”
“সমস্যা?আপনি
কি করে জানলেন?”
“আপনাকে
দেখে মনে হচ্ছিল কোন বিষয়ে আপনি ছিন্তিত,তাই বললাম।”
“হ্যাঁ,পরেছি
তো,বা বলতে পারো পরেছিলাম,তুমি সেটা কাটিয়ে দিলে।”অচেনা মেয়েটা বলল।
“আমি?আমি
কিভাবে আপনার সমস্যা...”
“আচ্ছা,আমরা
কি এইভাবে মাঝরাস্তায় দাঁড়িয়ে কথা বলব?” রীতিমত বকুনির মত করে কথাটা সে বল্ল,কে
বলবে কয়েক মুহূর্ত আগে এই মেয়েটাই মাঝরাস্তায় কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
আমরা রাস্তা পার করে ফুটপাথ ধরে হাঁটতে লাগ্লাম,আজ বহুযুগ পরে সকালের চা-টা আমি
স্কিপ করলাম।
“আচ্ছা,প্রথমে
এই আপনি বলাটা বন্ধ কর,কিরকম বয়স্ক মনে হয় নিজেকে,আর তুমি
বলা শুরু করো।”
“আচ্ছা,ঠিক আছে।এবার আগে
এটা বলো আমি কিকরে তোমার সমস্যা দূর করলাম,আর সমস্যাটাই
বা কি?”আমি বললাম।
“Actually,আমার
কোনও বয়ফ্রেন্ড ছিলনা, সত্যি বলতে গেলে কোন ছেলেই সত্যি করে আমায় ভালবাসেনা,এখানেই
সমস্যা।”
মনে
মনে ভাব্লাম-এরকম কেউ কেন ভালবাসতে জাবে,কিন্তু মুখে বললাম, “ও আচ্ছা,জটিল
সমস্যা।কিন্তু আমি প্রবলেমটা সলভ করলাম কিকরে?”
“ভালোবেসে।”
“কি!ভালবেসে?কে,কাকে
ভালবাসে?”
“তুমি,আমায়।You
love me.” মেয়েটা মুচকি হেসে বলল।
“I….what?”আমার
মাথায় যেন বাজ পরল।
“ইংরেজী
বোঝোনা?তুমি আমায় ভালোবাসো।”
এতো
আচ্ছা পাগলের পাল্লায় পরা গেল, “তোমাকে কি ডাক্তার এর কাছে নিয়ে যেতে হবে?আমার মনে
হচ্ছে,You need a doctor.”
“কোন
ডাক্তার এর দরকার নেই আমার।আর দাঁড়িয়ে পরলে কেন,কি দেখছ অমন করে আমার দিকে,চল
হাঁটো।”বেশ ধমকের সঙ্গে মেয়েটা বলল।
“আমি
তো তোমাকে চিনি না,আমি কিকরে তোমাকে ভালবাসতে পারি,এটা বুঝতে পারছিনা,বুঝিয়ে দবে
প্লিজ।”আমি বললাম।
“তাহলে,আমাকে
বাঁচাতে এলে কেন, ওভাবে নিজের প্রাণের রিস্ক নিয়ে?”
“আরে,সে
তো মনুষ্যত্বের খাটীড়ে,কেউ চোখের সামনে কাউকে মরতে দিতে পারে নাকি?”
“তাই
বুঝি?”ব্যঙ্গ করে ও বলল।
“তাই
না?”আমি প্রশ্ন করলাম।
“তুমি
ছাড়াও ঐ চায়ের দোকানে জনা পাঁচেক লোক ছিল,এছাড়াও রাস্তার এদিকে ওদিকে আর বেশ কিছু
লোক ছিল,তুমি বলতে চাও তাদের কারো মনুষ্যত্ববোধ নেই,শুধু তোমারই আছে?”
“না,আমি
তা বলছিনা,তবে হতে পারে তারা কেউ তোমায় লক্ষ্য করেনি,সেইজন্যে বাঁচাতে আসেনি।”
“বুঝতে
পারছ, শুধু তোমারি চোখে আমি এলাম,আরে এর মানে্…”
“একমিনিট,তুমি
তো আনমনে দাঁড়িয়ে ছিলে মাঝরাস্তায়,তাহলে কে কোথায় বসে আছে,দাঁড়িয়ে আছে,সেসব তুমি
খেয়াল করলে কি করে,নাকি তুমি..”
“আমার
হুঁশ ছিল।আমি দেখছিলাম কেউ আমায় বাঁচাতে আসে কিনা।”
“গ্রেট,আর
যদি আসে তারমানে সে তোমায় ভালবাসে।হে ভগবান তুমি আমায় এ কার পাল্লায় ফেললে?”
“বিশ্বাস
হচ্ছেনা আমার কথায়,আচ্ছা তুমি কি সাইকোলজির ছাত্র?”ও প্রশ্ন করল।
“না,আমি..”
“আমি
সাইকোলজির ছাত্রী, তাই তোমার থেকে আমি অনেক বেশি বুঝি Human
behaviour.”
“আমি
কি স্বপ্ন দেখছি?”প্রস্ন করলাম আমি,তবে উত্তরটা পেতে এক মুহূর্ত দেরী হলনা।সজোরে
একটা চিমটি কাটল ও আমার
হাতে,আমি কোনমতে নিজের হাত-টা ছাড়িয়ে নিয়ে বল্লাম,”কি হল কি,চিমটি কাটছো কেন?”
“তোমায় বোঝালাম যে তুমি স্বপ্নে
নয়, বাস্তবে আছো।”মেয়েটা বলল।
“বূঝে
গেছি আমি।”আমি বললাম।
“আমি
বুঝতে পেরেছি তোমার গার্লফ্রেন্ড আছে,তাই
তুমি আমায়..”
“না,না,আমার
কোন গার্লফ্রেন্ড নেই,আমি ব্যাচেলর।”
“তাহলে
আমায় হয়তো দেখতে বাজে,তাই তোমার..”
“আমি কি
তাই বলেছি,তোমায় অসাধারন দেখতে,You are beautiful.”আমি
মুচকি হেসে বললাম।
“আমি
জানতাম সেতা,তাহলে এতো ভনিতা করছ কেন?”
“না,মানে
এভাবে কাউকে না জেনে-শুনে,কারোর সাথে সময় না কাতিয়ে, সরাসরি কিভাবে..”
“তোমার ফেসবুকে নিশ্চয়ই
অ্যাকাউন্ট আছে?” ও প্রশ্ন করল।
“হ্যাঁ আছে।”
“ফেসবুক এর কোন
চ্যাটফ্রেন্ড এর সাথে তুমি কখনো মিট করেছ?”
“হ্যাঁ,বারদুয়েক করেছি।”
“তাহলে তো প্রবলেম
সলভ,তোমার কাছে নিশ্চয়ই Smartphone আছে?তাহলে ওটা বের করো।”
“সে আছে,কিন্তু কেন?আমি
তো কিছুই বুঝতে পারছিনা।”
“অতো বুঝে তোমার লাভ
নেই।তুমি বরং ফেসবুকটা অন করো,আমিও অন করছি,তুমি আমায় একটা ফ্রেন্ড রিকো্যেস্ট পাথাও,আমি
সেটা আক্সেপ্ট করছি।তারপর ওখানে চ্যাট-এ তুমি আমায় একদিন,মানে আজ এ দেখা করতে বল,
এবং আমি তাতে রাজি।অর্থাৎ,এখন এই মুহূর্তে আমরা একটা ডেট-এ বেরিয়েছি।এরপর তো তোমার
আর কোন অসুবিধা থাকার কথা নয়,আমার সাথে আজ সারাটা দিন প্রেম করতে, কি কোন অসুবিধা
আছে?”
“দুরন্ত এক্সপ্রেস ও এর
থেকে ধীরে চলে,আমি কিছু ভালো করে বুঝবার আগেই বলে বসলাম, “এত কিছু করার ও আর কোনো
দরকার নেই,আমি রেডি,আজকের এই ডেট-এর জন্য।”জানিনা তবে এই প্রথমবার মনে হল,আমি
সত্যি-ই মেয়েটাকে ভালবেসে ফেলব।
“কি হল,কি ভাবতে বসে
গেলে?চল কোথাও,সারাদিন কি শুধু ফুটপাথ ধরে হাঁটবো নাকি?”
“একদম নয়,তবে এই জগিং-এর
ট্রাকস্যুট পরে তো আর ঘুরতে যাওয়া যাবেনা।তুমি একটু ওয়েট করো আমি দশ মিনিটের মধ্যে
চেঞ্জ করে আসছি।”
“ঠিক আছে,স্যার।”ও
মস্করা করে বলল।
আমি বারির দিকে যাওয়ার
জন্যে পা বারিয়েছিলাম,কিন্তু একটা প্রশ্ন মনে এল,তাই আবার ওকে জিজ্ঞেস করলাম,
“আপনার নামটা এখনো জানা হয়নি,মিস আন-জানা।”
“আপনি ও আপনার নাম বলেন
নি এখনো।”
“তুমি তো জিজ্ঞেস করনি।”
“সবকিছু কি আমায় আগে
করতে হবে,নাম বলাটা কি তোমার দায়িত্ব নয়,তুমি কেন…”
“তৃণাভ..তৃণাভ ঘশ।এবার আপনার-তা
জানতে পারি কি?”
“সৃজা দাসগুপ্ত।এবার
জলদি গিয়ে চেঞ্জ করে আসুন।”
৷২৷
সৃজার সঙ্গে কাল সারাটা দিন যে কিভাবে কেটে গেল বুঝে
উঠতেও পারলামনা মনে হল চোখের পলকে যেন একটা আস্ত দিন পার করে ফেললাম।আমার এই
রোজনামচার বোরিং মার্কা জীবনে শেষ কবে যে এতো প্রাণবন্ত একটা দিন
কাতিয়েছিলাম-মস্তিস্কে হাযার করাঘাত করেও সেটা মনে করতে পারলামনা।সিটি সেন্টার
থেকে গড়ের মাথ,নিউ মার্কেট থেকে নিক্কো পারক-এক দিনে সবটা আমরা ঘুরে
ফেল্লাম,এরপ্রায় প্রত্যেকটাতেই শেষ একবছরে আমি একবার ও পা ফেলিনি।ওর সাথে সময়
কাটাতে কাটাতে মনে হচ্ছিল আমরা একে অপরকে যেন কতদিন ধরে ছিনি,পরস্পরের
পছন্দ-অপছন্দগুলো আমাদের যেন সব-ই জানা।যত দিনটা গড়িয়েছে ততো আমার মনে
হ্যেছে,সৃজা-ই থিক,আমি হয়তো অনেক আগে থেকেই ওকে ভালোবাসি,শুধু আমাদের সামনা-সামনি
আসতে এতটা দেরী হয়ে গেল।জানি
লোকে হয়তো আমাকে পাগল বলবে,কিন্তু পাগলামির অন্য নাম-ই তো ভালোবাসা।
সৃজা আজ আমায় ওর বাড়িতে আসতে বলেছিল,আমি ও কোনকিছু
না ভেবে তাতে হ্যাঁ বলে দিয়েছিলাম।এখন গন্তব্য সৃজার বাড়ি,হাতিবাগানের হরি ঘোষ
স্ট্রিটে,কুহেলি নামের একটা অ্যাপার্টমেন্টে ওরা থাকে।ফ্ল্যাট টা খুঁজে বের করতে
বেশী সময় লাগলনা,ওকে দেখার জন্য চোখ দুটো উতলা হয়ে রয়েছে আর তাই দেরী না করে
কলিং-বেল টা বাজালাম।
“কাকে চাই?”এক মাঝবয়সী ভদ্রমহিলা দরজা খুলে বললেন।
“সৃজা বাড়িতে আছে?আমি ওর কলেজ ফ্রেন্ড।”এর থেকে
যুতসই কোন মিথ্যে আমার মুখে এলনা।
“সৃজা?”ভদ্রমহিলাকে দেখে মনে হল উনি যেন নামটা শুনে
আকাশ থেকে পরলেন।
“হ্যাঁ,ওই আমায় কাল বাড়িতে আসতে বল্ল,তাই আমি…”
“সে তো বুঝলাম,কিন্তু ঐ নামে এখানে কেউ থাকেনা।”
“থাকেনা?ও তাহলে হয়তো আমি ফ্ল্যাটের নম্বরটা গুলিয়ে
ফেলেছি,হয়তো অন্য কোন ফ্লোরে হবে।”
“না,এই আবাসনে ঐ নামে কেউ থাকেনা এব্যাপারে আমি
নিসছিত।কি নিয়ে পড়াশোনা করছ তোমরা?”
“আজ্ঞে,সাইকোলজি।”অনেক কষ্ট করে আমি বললাম।
“না,আমাদের এখানে কেউ সাইকোলজির ছাত্র নয়,দেখ কেউ
হয়তো তোমার সাথে মস্করা করেছে।”
“মস্ক্রা!!”নিজেকে অনেক কষ্ট করে সামলে নিয়ে আর ঐ
মহিলাকে বিব্রত করার জন্যে ক্ষমা চেয়ে আমি বেড়িয়ে এলাম।পৃথিবীর সমস্ত ভার এই
মুহূর্তে যেন আমার উপর কেউ চাপিয়ে দিয়েছে,শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে।কোথায় যাব,কি করব
কিছু-ই বুঝে উঠতে পারছিনা।কেউ
কি কারো সাথে এইভাবে রসিকতা করতে পারে,এসব ভাবছি,ঠিক সেই সময় কেউ আমার নাম ধরে
ডেকে উঠল, নতুন বিশ্বাস এ ভর করে ঘুরে তাকালাম আমি, গলার স্বরটা পরিছিত,মন বলছে
সৃজার—কিন্তু নিজের চোখ ছাড়া আর কিছুকে বিশ্বাস করতে মন চাইছেনআ।কিন্তু আমার কান
যে ভুল শোনেনি তা ঘুরে তাকানোর সাথে সাথে বুঝতে পারলাম।আমার থেকে হাত দশেক দূরে
মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে সৃজা।
দেরী না করে ছুটে গেলাম ওর দিকে,“কি ব্যাপার,তোমার
বাড়ি গেলাম কিন্তু ওখানে এক মহিলা বললো এখানে সৃজা নামে কেউ থাকেনা,এর মানেটা কি?”
“ওটা আমার বাড়ির ঠিকানা নয়,উনি ঠিক-ই বলেছেন।”শান্তকন্ঠে
ও বলল।
“তাহলে তুমি এখানে কি করছ?আমি তো তোমার বাড়ি যেতে
চাইনি,তাহলে নিজে থেকে ভুল ঠিকানা দেওয়ার অর্থ কি?মিথ্যের আশ্রয় নেওয়ার হলে,এখন আবার
সামনে এলে কেন?”
“আসলে স্যার সামনে না এলে আপনার নতুন মেগা সিরিয়াল-এ
সুযোগ পাবো কি করে?
“মেগা সিরিয়াল?তুমি কি নতুন কোন ঠাট্টা শুরু করলে
আমার সাথে?”
“না স্যার,আমার বান্ধবী চান্দ্রেয়ী বলেছিল আপনি নাকি
এভাবেই রোজকার জীবনের চরিত্রগুলোর থেকেই আপনার সিরিয়াল এর অভিনেতাদের নিয়ে
থাকেন,তাই আমি কাল….”
“কিসের সেরিয়াল?আমি কোন ডাইরেক্টর বা অভিনেতা নই,আমি
একজন ডেন্টিস্ট তারসাথে একটু গানবাজনা করি,এরমাঝে সিরিয়াল…”
“আপনি ডাইরেক্টর নন? ‘অচিন সেই
পাখি’ সিরিয়াল এর ডাইরেক্টর…”
“না,না,না,আমি কোন ডাইরেক্টর নই।আমি খুব দুঃখিত,আমার
পিছনে আপনি অকারণে একটা আস্ত দিন নষ্ট করলেন।বিশ্বাস ক্রুন,আগে জানলে এমনটা আমি
হতে দিতামনা।যাই হোক,আপাতত সব ধোঁয়াশা যখন কেটেই গেছে,তখন আমাদের এই বৃথা
বাক্যব্যয় করে তো আর কোন লাভ নেই,আমি বরং আসি আর আশা করি আপনি আপনার ডাইরেক্টরকে
দ্রুত খুঁজে পাবেন,চলি।”আমার পায়ের তলা থেকে জমি যেন সরে সরে জাচ্ছে,এক মুহূর্ত
আগে সৃজাকে দেখে মনের ভিতর নতুন করে যে আশার সঞ্চার হয়েছিল সেটা গাঢ় অন্ধকারে
তলিয়ে যাচ্ছে।জীবনের পরপর দুটো দিন আমার জন্যে যে এতটা বিপরীতমুখী হবে তা কখনো
কল্পনাও করিনি।সব কথা,হাসি,প্রেম-মিথ্যে,সব কিছু মিথ্যে।আমি জোর গতিতে হাঁটা শুরু
করলাম,কিন্তু ঠিক সেই সময় পিছন থেকে আবার কেউ ডেকে উথল,তবে এবার আর আমার স্কুলের
নামটা ধরে নয়,ডাক এল ‘মি. কিটক্যাট’ বলে।
হৃদয় এর মধ্যে কেউ যেন তড়িৎ সঞ্চার করল,বহু বছর আগে
নিভে যাওয়া বাতিটা যেন কেউ আবার জ্বালিয়ে দিল।পিছনে ঘুরে দেখতে বেশ ভয় করছে,অনেক
কষ্ঠ করে ঘুরে তাকিয়ে দেখি,সৃজা হাসছে,আমার সাথে যে কি হচ্ছে কিছুই বুঝে উঠতে
পারছিনা।
“আমার এই নামটা তুমি জানলে কি করে?”আমি জিজ্ঞেস
করলাম।
“উফফ,কোথায় ভাবলাম যে ঘুরে তাকিয়ে কাঠবেড়ালী বলে
ডাকবে,তা না একটা বোরিং প্রশ্ন করে বসল।”
“মানে,সৃজা দাসগুপ্ত বলে কেউ নেই,আর এই মুহূর্তে
আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন মিস তৃষা রায়।”আমি একগাল হেসে বললাম।
“রায় না,রয়,তৃষা রয়।”ছোটবেলার স্বভাবটা ওর এখনো
কাতেনি।আমি আর তৃষা একসাথে প্রাইমারি স্কুলে ক্লাস ফোর অবধি পড়েছিলাম অর্থাৎ
সহপাঠী, তারপর ওর বাবা নর্থ বেঙ্গল এ ট্রান্সফার হয়ে জায়,সেই থেকে আমাদের আর কোন
যোগাযোগ নেই।স্কুলে পড়াকালীন আমি রোজ ওর জন্যে কিটক্যাট নিয়ে যেতাম,তাই আমি ওর
কাছে মি কিটক্যাট আর ও সেই কিটক্যাটের আধা নিজে খেত আর বাকিটা আমাকে না দিয়ে
স্কুলের গাছের কাঠবেড়ালী-টাকে খাওয়াতো,তাই ও মিস কাঠবেড়ালী।
“কলকাতায় কবে ফিরলি?আর আমায় চিনলি কি করে?”আমার যেন
কিছু বিশ্বাস হচ্ছেনা।
“বছর ছয়েক হয়ে গেল,আগে আমরা যাদবপুরে ছিলাম,এই মাস
পাঁচেক হল কুহেলি-তে শিফট করেছি, তুই যে ফ্লোরে গেছিলিস ওর উপরতলায়।আর তোকে দেখে
চিনতে পারিনি- কোনোদিনই হয়তো পারতামনা,কিন্তু সেদিন কাকিমাকে দেখতে পেলাম
হঠাৎ,হাতিবাগান বাটার সামনে। কাকিমার সাথে একটা গুণবন্ত ছেলেও ছিল,খালি ‘মা-মা’
করছিল, সুতরাং ওটি মি কিটক্যাট।”
“তুই কি পেশায় গোয়েন্দা?আমার বাড়িটা চিনলি কি করে?”
“ঐ তো,সেদিন তোদের পিছু করতে করতে এসে চিনে গেলাম।”
“তুই তো ফেলুদাকে বিপাকে ফেল্বি?”কথাটা বলে দু’জনে
একসাথে হেসে উঠলাম।
“একটা প্রশ্ন এখনো থেকে যায়, এই সৃজার ছদ্মবেশ
কেন?”আমি জিজ্ঞেস করলাম।
“এতগুলো বছর কেটে গেছে,ছোটবেলার সেই ছেলেটা এখনো যে
আগের মতোই আছে তার কি প্রমাণ?তাই প্রথমে কাছ থেকে একটু বুঝে নিতে চেয়েছিলাম।তারপর
যখন বুঝলাম ছেলেটা একইরকম আছে,তখন এই পাগলামির প্ল্যানটা মাথায় এল।আমার মনের
কথাগুলো সৃজা হয়ে বলা অনেক সহজ ছিল,তৃষা হয়ে সেটা বলা সম্ভব ছিলনা,তাই…….”
“তাই ভাবি,এরকম হুট করে কোন মেয়ে কি কাউকে ভালোবাসে
নাকি?”
“বাজে কথা বলিসনা,মনে মনে তো খুশীতে ডগবগ করছিলিস।”
“না না,ছাড় সে সব কথা।আচ্ছা এই ডাইরেক্টর-এর গল্পটা
কেন বললি?”
“যা বাবা,তুই তো ছেলেবেলায় বলতিস,আমি নাকি হিরোইন হব
আর তুই আমায় নিয়ে সিনেমা বানাবি।”ব্যঙ্গ করে ও বলল।
“কিছুই ভুলিসনি দেখছি।মনে হচ্ছে যেন স্বপ্ন
দেখছি,”তৃষা হাতটা বাড়াতে যাচ্ছিল,কিন্তু আমি তার আগেই বলে উঠলাম, “চিমটি কাটতে
হবেনা, স্বপ্ন নয় সত্যি,আমি জানি।”
“তোকে কতো খুঁজেছি ফেসবুকে জানিস?পেলাম না কিছুতেই।”
“আমি অতো ফেসবুক করিনা,সব তাই ব্লক করে রেখেছি।”আমি
বললাম।
“কেন রেখেছ?”
“না রাখলে আমাদের এই সুন্দর প্রেমকাহিনী-টাই যে হত
না।”
“কিন্তু…..”
“একমিনিট।”
আমাদের
প্রেমের এই দ্বিতীয় ইনিংসটাকে আমরা দুরন্ত গতিতে এগিয়ে নিয়ে যাই- আপনারা নিশ্চয়ই
সেটাই চাইবেন। তাহলে এখনকার মত আমার গল্প বলা শেষ আর প্রেমের শুরু।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন