ছোটগল্প-দুর্জয় বৈদ্য

দশ হাজার সাতশত আঠাশ মাইল

  দুর্জয় বৈদ্য



(
)


নিভৃতের সাথে দীপার প্রথম দেখা হয় একটা আর্ট এক্সিবিশনে । দীপা ঘুরে ঘুরে দেশের খ্যতনামা চিত্রশিল্পীদের ততোধিক খ্যাতিসম্পপন্ন বা খ্যাতি লাভের সম্ভাবনা সম্পন্ন চিত্রকর্মগুলো দেখছিল । গ্যালারিতে খুব বেশি ভিড় ছিল না , এই ধরণের প্রদর্শনীতে থাকেও না সাধারণত । তাই গ্যালারিতে বিস্তার করছিল ভদ্রস্থ নীরবতা । এরই মাঝে দীপা শুনতে পেল কে যেন বিরক্তি মাখা কণ্ঠে  বলছে – “ধুর ! কি যে আঁকা হয় আজকাল ; কাকের ঠ্যাঙ আর বকের ঠ্যাঙ ।    শুনে তো দীপা পুরো থ ! এখানে যেসব ছবি প্রদর্শিত হচ্ছে  সেগুলোর প্রতিটাই চড়া দামে বিক্রি হয় ।  কোথাকার অল্প বয়স্ক একটা ছেলে এসে এসব ছবিকে যাচ্ছেতাই বলছে , কি আজব !  

দীপা ভাবলো ছেলেটার সাথে একটু কথা বলবে । তাকে জিজ্ঞাসা করবে এই ছবিগুলোর কোন জায়গাটা তার কাছে কাকের ঠ্যাঙ , বকের ঠ্যাঙ মনে হচ্ছে । এই জন্য সে ছেলেটার কাছাকাছি গেলো সে । সাধারণত এই ধরণের পরিবেশে , সাদা বাংলায় যাকে বলে সারকামস্টেন্স ; সেখানে ছেলেটাই এগিয়ে এসে কথা বলে । কিন্তু কালোমতোন , ছোটখাটো ভুঁড়িওয়ালা , ঝাঁকড়া চুলের ছেলেটা দীপার উপস্থিতিকে কোনোরকম তোয়াক্কা না করে সেখান থেকে গটগট করে বের হয়ে গেলো । আর দীপা অল্প সময়ের মধ্যে দ্বিতীয়বার থ বনে গেলো । 

 
(
)

 এর কিছুদিন পরে দীপা তার এক পাগল কবি বন্ধুর অক্লান্ত অনুরোধে সাড়া দিতে গেলো এক কবিতা পাঠের আসরে । কবিতা তার ভালো লাগে না খুব একটা , কিন্তু কবি বন্ধুটি তার খুব কাছের একজন বন্ধু । তাই আসা । 

যা-ই হোক । গিয়েই দেখে সেখানে গোল হয়ে বসে আছে আলুথালু বেশের ২০-২৫ জন মানুষ । জানা গেলো মানুষগুলোর কয়েকজন তরুণ কবি আর বাকিরা শ্রোতা । কবিতাচক্রের প্রধান অতিথি হিসেবে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে দেশের নামকরা এক  কবিকে । 

দীপা এদিক-সেদিক তাকিয়ে তরুণ কবিদের দেখছিলো । কীভাবে যে মানুষজন এই ধরণের আজাইরা কাজ করতে পারে , তা তার বোধগম্য হয় না কখনো ।  হঠাৎ তার চোখে পড়ে সেদিনের সেই কালোমতোন , ছোটখাটো ভুঁড়িওয়ালা , ঝাঁকড়া চুলের ছেলেটা । হাতে একটা খাতা নিয়ে বসে আছে একপাশে আর মোটা চশমার মাঝখান দিয়ে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে । কিন্তু কারো সাথে তেমন একটা কথা বলছে না । 

কিছুক্ষণ পর প্রধান অতিথি এলেন । কবিতার সমসাময়িকতা নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ একটা আলোচনা চলল । এরপর শুরু হল স্বরচিত কবিতা পাঠের আসর । দীপার মাথার উপর দিয়ে গেলো অধিকাংশ কবিতা , অধিকাংশ সময়ে তা-ই যায় । সবার শেষে কবিতা পাঠ করলো ছেলেটি  খুব ছোট একটা কবিতা , কিন্তু কবিতাটা দীপার মনে গেঁথে গেলো । 
 
 তুই সুখ হতে চাস না আমার ,
তোকে ভুলতে সময় নেবো না আমি ।
তার চেয়ে দুঃখ হয়ে থাক আমার ,
দুঃখটা হয়ে যাক দামী ।

কবিতা পাঠ শেষে দীপা পরিচিত হতে গেলো ছেলেটির সাথে ,ততোক্ষণে নাম জানা হয়ে গিয়েছে ; নিভৃত   

আপনার কবিতাটা খুব ভালো লেগেছে আমার ।” – হাসি হাসি মুখ করে বলল দীপা ।

ভালো জিনিস তো ভালো লাগবেই । কি ভাব রে বাবা ! ভাবলো দীপা ।

সেদিনের মতো আলাপচারিতা সেখানেই শেষ   


(
)
বাসায় এসে দীপা ফেসবুক ওপেন করেই পেলো নিভৃতের বন্ধু হওয়ার অনুরোধ । খুশি হয়েই গ্রহন করলো সে । এরপর থেকে শুরু হল তাদের চ্যাটিং ।  

দীর্ঘ ডিজিটাল আলাপচারিতার মাঝে তাদের একে অপরকে খুব ভালো করেই জানা হয়ে গেলো । আপনি থেকে তুমি আসতে সময় লাগলো না , তার চেয়েও কম সময়ে তুই-এ চলে এলো তারা ।নিভৃতের বিবিধ বিষয়ে অতি-জ্ঞান , নিজেকে নিয়ে উচ্চমার্গীয় চিন্তা , এসব আপাতদৃষ্টিতে হাস্যকর মনে হলেও দীপার কাছে এসবের কারণেই নিভৃতের  অপরিহার্যতা দিন দিন  বাড়তে লাগলো । 

তবে এই ভালোলাগার প্রসারণটা দুই দিক থেকেই প্রায় সমানভাবে হচ্ছিল , কিন্তু কেউই কাউকে জানাচ্ছিলো না । কেন যে জানাচ্ছিলো না তা বোধহয় স্রস্টারও অজানা । 


(
)

আচ্ছা , তুই কি আমাকে ভালোবাসিস ?” হুট করে প্রশ্ন করলো দীপা

তোর কি মনে হয় ?”  সাথে সাথে জবাব দিল নিভৃত । 

আমি তোর কাছ থেকে শুনতে চাই ।

আমি তোর কাছ থেকে তোর ভাবনাটা জানতে চাই ।

কিছুক্ষণ দুজনেই চুপচাপ । নীরবতাটা ভাঙলো নিভৃত নিজেই । 

দ্যাখ , তোকে আমার অনেক ভালো লাগে । অনেক , অনেক , অনেক । নিজেকেও এতোটা লাগে না । কিন্তু আমি কনফিউসড । তুই আর আমি এত ঘনঘন দেখা করছি , এত কাছাকাছি মিশছি । তাই আমাদের মাঝে আবেগ জেগে ওঠাটা আশ্চর্য নয় ।কিন্তু সেটা কি ভালোবাসা নাকি অন্যকিছু সেটা আমি এখনো বুঝে উঠতে পারি নাই । আমি কি তোকে ব্যাপারটা বুঝাতে পেরেছি

দীপা সব শুনে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলো । নিভৃতের চোখের দিকে তাকিয়েই সে বুঝতে পারলো যে সে তাকে প্রচণ্ড ভালোবাসে , কিন্তু গোঁয়ার্তুমির কারণে বলছে না । 

দীপা আর কথা না বাড়িয়ে সেখান থেকে উঠে চলে গেলো ।


(
)

এরপর ২-৩ সপ্তাহ কেটে গেলো । দীপা আর নিভৃতের মধ্যে কোন ধরণের যোগাযোগ হয় না । নিভৃতও করে না , দীপাও করে না । ।

একদিন হঠাৎ নিভৃতের মুঠোফোনে দীপার একটা ক্ষুদেবার্তা এলো । --“আমি ইউ,এস, , চলে জাচ্ছি । বাকি পড়াশনাটা ওখানেই করবো । আমাদের কাছাকাছি থাকার কারণে তুই কনফিউসড ছিলি , আশা করি এবার তোর কনফিউসন দুর হবে ।  

মেসেজ পেয়ে নিভৃতের মাথা খারাপ হওয়ার দশা । সে ভেবেছিলো এবার দেখা হলেই সে সোজাসুজি প্রপোস করে বসবে । সে তখনই ফোন করে দীপাকে । জানতে পারে দীপা এয়ারপোর্টে । নিভৃত ছুট লাগায় ।  

কিন্তু দীপার সাথে তার দেখা হয় না । হন্তদন্ত হয়ে নিভৃতের পৌঁছানোর ১০ মিনিট আগেই বোর্ডিং জোনে ঢুকে যায় দীপা ।

()
নিভৃত নিজের রুমে বসে গান  শুনছিল । এমন সময় তার রুমমেট এসে তাকে জানায় যে দুবাই এয়ারপোর্টে একটা প্লেন টেক-অফ করার সময় ক্রাশ করেছে । পাইলটসহ সকল যাত্রী মারা গিয়েছে । নিভৃত প্রথমে খবরটা শুনে তেমন একটা পাত্তা দেয় নি , কিন্তু খানিক বাদে অজানা একটা আশঙ্কায় তার মন দুলে উঠে । সে দীপার বাসায় ফোন করে এবং তার আশঙ্কা সত্যি প্রমাণিত হয় । 

ঐ ফ্লাইটের একজন যাত্রী ছিল দীপা । নিভৃতের মনের নিভ্রিতস্থলটা নিঙরে কান্না বের হয়ে আসে । 

পুরুষ মানুষের কান্না খুব ভয়ঙ্কর , স্বজন হারানোর কান্না তো আরো বেশি । 


(
)

এক সপ্তাহ পরে নিভৃত ক্লাস শেষ করে রুমে আসে । তার রুমমেট তার হাতে একটা চিঠি ধরিয়ে দেয় । নিভৃত অবাক হয় ভীষণ । এই ই-মেইলের যুগে কে আবার চিঠি পাঠালো । চিঠির উপরে প্রেরকের নাম দেখে আরো অবাক হয়ে যায় , সেখানে দীপার নাম লেখা । কাঁপা হাতে খাম থেকে চিঠিটা বের কুরে পড়তে শুরু করে সে  

প্রিয় নিভৃত ,
তোকে আজ জীবনে প্রথম চিঠি লিখছি । আসলে এটাই আমার জীবনের প্রথম চিঠি । এই ইন্টারনেটের যুগে তোকে চিঠি লেখার কারণটা আগে বলি । আসলে এই মুহূর্তে আমার কাছে ডিজিটাল হরফের চাইতে আমার হাতের লেখাটা তোর কাছে পৌঁছানোটা জরুরি মনে হচ্ছে তাই কাগজ কলম হাতে তুলে নেওয়া । 
দুবাই এয়ারপোর্টে বসে আছি । চার ঘণ্টার যাত্রা-বিরতি চলছে । গুগল ম্যাপ ব্যবহার করে দেখলাম তোর কাছ থেকে প্রায় দশ হাজার সাতশত আঠাশ মাইল দূরে চলে এসেছি । এই দীর্ঘ দূরত্বটা তোর মনের কনফিউসন দূর করার জন্য যথেষ্ট কিনা তা জানি না , কিন্তু আমার জন্য যথেষ্ট । আমি তোকে সত্যিই অনেক ভালোবাসি , তুই বাসিস আর না বাসিস । যদিও এটা কোন প্রশ্ন নয় , তবু তোর উত্তরের অপেক্ষায় রইলাম । 
আর এই চিঠিটা যখন তোর হাতে পৌঁছাবে তখন আমি আরো দূরে চলে যাবো , বলতে গেলে তখন গ্লোবের একপাশে তুই , আর ঠিক অন্যপাশে আমি । আশা করি সেই দূরত্বটা তোর মনের সমস্ত জটিল সমীকরণের সহজ সমাধান দিতে পারবে ।
আর লিখতে পারবো না রে । চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে । ভালো থাকিস তুই  

ইতি --
তোর (যদি তুই ভাবিস) দীপা     
নিভৃত চিঠিটা হাতে নিয়ে বসে রইল , বুকের কাছে জাপটে ধরে থাকলো অনেকক্ষণ । তার চিৎকার করে বলতে ইচ্ছা করছিলো , জানাতে ইচ্ছা করছিলো তার ভালবাসার কথা । কিন্তু হায় ! যে মানুষটা শুনবে সেই তো আর নেই । 

হঠাৎ পাশের রুম থেকে গানের সুর ভেসে এলো -- 

  
আমার ভিনদেশি তারা একা রাতেরই আকাশে
তুমি বাজালে একতারা আমার চিলেকোঠার পাশে
ঠিক সন্ধ্যা নামার মুখে
তোমার নাম ধরে কেউ ডাকে
মুখ লুকিয়ে কার বুকে তোমার গল্পো বলো কাকে 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন