ছোটগল্প-অর্নিবাণ মিত্র চৌধুরী

দাও বিদায়

অর্নিবাণ মিত্র চৌধুরী


এবার যাবার পালা। একে একে সবার কাছ থেকে বিদায় নেবার পর বোনটি তার দাদার
সামনে এসে দাঁড়ায়। দাদা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। বোনটি তার দাদাকে
ডাকলো, "দাদা, দ্যাখ আমি কিছুক্ষণ পর চলে যাব। আমায় বিদায় দিবি না?"
দাদা মাথা নাড়ে। তার মুখে কোনো জবাব নেই। বয়সে দু'বছরের ছোট এই বোনটির
প্রতি তার অগাধ মায়া আর ভালোবাসা। বাবা-মাকে হারিয়েছে সেই ছোটবেলাতেই।
সেই থেকেই যেন দাদা-বোন কখনো একে অন্যের গার্ডিয়ান, কখনো বন্ধু, কখনো
দু:-সুখের সাথী। সম্পর্কটা যতটা না শ্রদ্ধার, ততটাই আস্থার, ততটাই
বন্ধুত্বের। দেখতে দেখতেই ১৫টি বছর এভাবেই কেটে যায়। বোনের বয়স তখন ২০ কি
২১ আত্মীয়-স্বজনরা বোনটির বিয়ে দেবার জন্য তোড়জোড় শুরু করে। দাদাটি রাজি
হয়না। এত তাড়াতাড়ি সে বোনের বিয়ে দেবে না। কিইবা এমন বয়স হয়েছে ওর? এখন
কি ওর বিয়ের বয়স? ওর পড়ালেখাও তো শেষ হয় নি এখনো। আত্মীয়রা দাদাটিকে
বোঝায়, ঘরে অবিবাহিত মেয়ে বেশি দিন রাখতে নেই। তাদের যত তাড়াতাড়ি পরের
ঘরে পাঠিয়ে দেয়া যায়, ততই মঙ্গল। দাদাটি শেষ পর্যন্ত ওদের কথাই মেনে নেয়।
তবে শর্ত থাকে যে, পাত্র দেখা থেকে শুরু করে সমস্ত দায়িত্ব তাদেরকেই নিতে
হবে, সে এসবের কিছুই জানেও না, করতেও পারবে না। বোনকে রাজি করানো থেকে
শুরু করে বিয়ের সমস্ত আনুষ্ঠানিকতা আত্মীয়রাই সেরেছে। ব্যাপারে সে
বোনের সাথে কোন কথা বলার সাহস পর্যন্ত দেখায় নি। উল্টো, বোনটিই একদিন
দাদাকে ডেকে তার বিয়ের শাড়ি-গয়না দেখিয়েছিল। বোনটির হাব-ভাব দেখে দাদার
মনে হয়েছিল, বোনের এই বিয়েতে অমত নেই, পাত্র নিশ্চয়ই বোনের পছন্দ হয়েছে।
দাদা মনে মনে বেশ খুশিই হয়। তার মনের আশংকা কেটে যায়। সে ভাবে, সত্যিই
মেয়েরা কত দ্রুতই না বড় হয়ে যায়। দাদাটি সেদিন বোনটিকে বলেছিল যে, সে তার
বোনকে চোখের জলে বিদায় দিতে মোটেই পারবে না। বোনটি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল
সে তার দাদাকে হাসিমুখেই বিদায় জানাবে। দেখতে দেখতে সেই লগ্ন আজ উপস্থিত।

-
কি রে দাদা, আমায় বিদায় দিবি না?
দাদার বুক ভারি হয়। বড় বড় নি:শ্বাস পড়তে থাকে। চোখ দু'টো ছলছলিয়ে ওঠে।
-
দাদা, এই দাদা। কি রে তুই কাঁদছিস?
=
কই? না তো
-
তো, তোর চোখ এত লাল কেন?
=
সারারাত জেগে আছি তো, তাই বোধহয়
-
আমাকে তো আজ একটু দেখতেও এলি না!
=
কি করবো বল? এদিকে ব্যস্ত ছিলাম যে
-
কেমন লাগছে বল আমাকে?
বোনের মুখের দিকে তাকাতে পারে না দাদাটি। মুখ ঘুরিয়ে বলে,
=
ভালোই তো। বেশ সুন্দরই লাগছে তোকে।
-
মুখ ফিরিয়ে রয়েছিস কেন? তাকা আমার দিকে
অপরাধীর মতন দৃষ্টিতে বোনের দিকে তাকায় দাদাটি। সত্যিই খুব সুন্দর
দেখাচ্ছে বোনটিকে। বধুবেশে একদমই চেনা যাচ্ছে না। হঠাৎ সবকিছু যেন ঝাপসা
লাগলো দাদাটির। চোখ বেয়ে অজান্তেই গড়িয়ে পড়লো অশ্রুধারা। বোনটি তার
দাদাটির চোখের জল মুছিয়ে দেয়।
-
তুই না বলেছিলি চোখের জলে আমায় বিদায় দিতে পারবি না  আর এখন নিজেই
কাঁদছিস? দেখ, আমি কিন্তু কাঁদছি না।
=
কই? না তো। কাঁদছি না তো! চোখে কিছু পড়েছে বোধহয়।
-
কি? দেখি, দেখি...
বোনটি উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে। এবার দাদাটি তার আবেগ ধরে রাখতে পারে না আর।
বোনটিকে জড়িয়ে ধরে হু হু করে কেঁদে ওঠে। বোনটিও কাঁদে, তবে নি:শব্দে।
দাদা-বোনের এই কান্নার দৃশ্য সবার হৃদয় ছুঁয়ে যায়। উপস্থিত সবার চোখে জল
আসে। ধীরে ধীরে বিদায়ের ক্ষণও এগিয়ে আসে। দাদা-বোনের কান্নাও থেমে যায়।
বোনটি দাদাটিকে উপদেশ দিতে থাকে - ভাল করে থাকবি, ঘর গুছিয়ে রাখবি,
ঠিকমতো খাবি ইত্যাদি, ইত্যাদি। বাধ্য ছাত্রের মত বোনের সবকথা মনযোগ দিয়ে
শুনে দাদাটি। তারপর আবার কিছুক্ষণ নিস্তব্ধতা।

-
কি রে আমাকে কিছু বলবি না?
=
কি বলবো বলতো? কিছুই তো ভেবে পাচ্ছি না।
-
সেটাও আমি বলে দেবো নাকি?
বোনের দিকে অসহায় চোখে তাকায় দাদাটি। এরপর আবার কিছুক্ষণ কারো মুখে কোন
কথা নেই। এবার নীরবতা ভাঙ্গলো দাদাটি -
=
মেয়েরা কত্ত তাড়াতাড়ি বড় হয়ে যায়, তাই না রে?
-
তুই- তো "বুড়ি" ডেকে ডেকে আমাকে বুড়ো বানিয়ে দিলি!
এবার দু'জনেই হাসে, সে হাসি আগের মতই - প্রাণোচ্ছল। হঠাৎ থেমেও যায়, সেই
হাসি আবার কান্নায় গিয়ে মিশে। কথা রাখতে পারে নি বোনটি। তার চোখ দিয়ে অঝর
ধারায় বইতে থাকে অশ্রুজল। চোখের জলেই বোনটিকে বিদায় দিতে হয় দাদাটির।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন